স্বপ্নেরা তবু ছুঁয়ে যায়: দু বছরের ও বেশি সময় ধরে একটা স্বপ্ন ছুঁয়ে ছিল আমায়। হ্যা৺, এখনো তাকে স্বপ্ন ই বলবো আমি। কিছু কিছু স্বপ্ন পূরণ হবার পরে ও যেন ঘুমঘোর থেকে যায়। নিজেকে চিমটি কেটে জাগিয়ে তুলে জিজ্ঞাসা করতে হয়, যা দেখে এলাম তা কি সত্যি? না কি, স্বপ্নের ঘোর?
হিমাচল প্রদেশ এর লাহুল আর স্পিতি ভ্যালি। শীতল মরুভূমি। গ্ৰেটার হিমালয়ান রেঞ্জ এর বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত বলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত এর পরিমাণ খুব কম। কোন কোন জায়গায় বৃষ্টি প্রায় হয় না বললেই চলে। সম্পূর্ণ উপত্যকা র অধিকাংশ জায়গার উচ্চতা ১০০০০ এবং তার বেশি অলটীচ্যুড এ ঘোরাফেরা করে। বাতাসের চাপ এবং অক্সিজেন- দুটো ই বেশ কম। পথ দূর্গম। ধ্বসপ্রবণ। কোন কোন জায়গায় না থাকারই মতো। অথচ, ল্যান্ডস্কেপ এর এত বৈচিত্র্য আমি অন্য কোথাও দেখিনি। হিমালয় এর এই রূপ আমার আগে কোথাও চোখে পড়ে নি। চোখ আর মন জুড়ে বসেছিল ধূসর পাহাড়ের কোলে চন্দ্রতালের নীল জলের অপার্থিব সৌন্দর্য। ইউটিউব ভিডিও দেখতে দেখতে মন অস্থির হয়ে উঠতো। সাথে ছিল ফেবু তে দেখা ছবি, যদিও সংখ্যায় কম। দু’বার প্ল্যান করলাম। সফল হলো না। যাদের নিয়ে করলাম তারা হয়তো নিজেদের ওপর ভরসা রাখতে পারে নি।😀। ওই রাস্তায় গাড়ি তে সোলো ট্রিপ করার যা খরচ, তা আমার পকেট এর আয়ত্তের বাইরে। কাজেই আশা প্রায় ছাড়তে বসেছিলাম।
আজ যখন এই স্বপ্নের জার্নি টা নিয়ে লিখতে বসেছি, একজনের কথা না বললে খুব অন্যায় হবে। রাহুল। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। ওর কাছে প্রথম যখন নিজের স্বপ্নের কথা বলি, ও বিশ্বাস করেছিল আমায়। ভরসা করেছিল। একটা ট্যুরিজম কোম্পানির ওনার, বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট। কিন্তু বন্ধুত্ব আর বিশ্বাসের বেশ শক্তপোক্ত একটা সম্পর্ক কিভাবে যেন গড়ে উঠেছিল। কখনো এক পয়সার ও বিজনেস দিইনি আমি রাহুল কে। তবু বন্ধুত্ব নষ্ট হয় নি। এই জায়গাতে ও আমি রাহুলের কাছে কৃতজ্ঞ। সব সম্পর্ক যে দেওয়া নেওয়া র ওপর নির্ভর করে টিকে থাকে না, এটা ও আমি রাহুল কে দেখে ই বিশ্বাস করতে শিখেছি। ফেসবুক আমায় যে দু চারটে সৎ মানুষ উপহার দিয়েছে তার জন্য আমি ফেসবুক এর কাছেও কৃতজ্ঞ। এই লেখায় রাহুলের সম্পর্কে এতগুলো কথা বলার একটাই কারণ, ও ভরসা করেছিল আমার স্বপ্ন কে। আমার সমস্ত পাগলামি তে সায় দিয়েছিল নির্দ্বিধায়। আর আমি ভরসা করেছিলাম ওকে। এই বছর জুন মাসে কথাপ্রসঙ্গে স্পিতি ভ্যালি নিয়ে আমার স্বপ্ন, আমার মধ্যেকার অস্থিরতা শেয়ার করেছিলাম আমি। এই বছর জুনে ই ১৩ তারিখ স্পিতি যাবার সব প্ল্যান তৈরি ছিল আমার। কিন্তু বিধি বাম। করোনার কারণে দলের কেউই আর সাহস পেলো না ট্রিপ টা করার। ধন্য আশা কুহকিনী!!! তখনও আশায় বুক বেঁধে বসে আছি আমি। এই বছরের শ্রেষ্ঠ সময় টুকু সেপ্টেম্বর এর শেষ। যখন স্পিতি ভ্যালি র আকাশ সবচেয়ে নীল থাকে।বর্ষা শেষ হওয়ার পর প্রকৃতিও থাকে ঝকঝকে। আর বেশি কি চাই!!!! অতএব নতুন করে দল গড়ে তোলা শুরু করলাম। স্পিতি তে ঢোকার দুটো পথের মধ্যে একটা সিমলা থেকে কিন্নর হয়ে। এই পথ ধ্বসপ্রবণ, কিন্তু বিপন্মুক্ত। হাতে দুটো দিন এক্সট্রা থাকলে মসৃণ ভাবে স্পিতি ভ্যালি তে প্রবেশ করা যায়। তারপর কুনজুম পেরিয়ে মানালি হয়ে নিষ্ক্রমণ। স্পিতি সার্কিট বেশিরভাগ মানুষ এভাবেই কমপ্লিট করে। আমার জন্মলগ্ন থেকেই সব কিছু অস্বাভাবিক। তাই , কোনকালেই এই রুটে র কথা ভাবিনি আমি। আমার প্ল্যান ছিল মানালি দিয়ে ঢুকে মানালি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। সুবিধা দুটো। ১. সময় কম লাগে।
২. অবধারিত ভাবে খরচ ও কম হয়। অসুবিধা গুলো ও মারাত্মক। রোটাং লা পেরিয়ে গ্ৰামফু থেকে বাতাল পর্যন্ত পুরোটাই অফ রোড। কার্যত অনেক জায়গায় রাস্তা নেই। দ্বিতীয় অসুবিধা টি আরো সাংঘাতিক। AMS অর্থাৎ, acute mountain sickness. মানালি দিয়ে স্পিতি ভ্যালি তে ঢোকার সবচেয়ে বড় সমস্যা এটাই। এত high altitude পরিবর্তন অনেকের শরীর ই মানিয়ে নিতে পারে না। আর বাতাসে অক্সিজেন কম হবার জন্য উপসর্গ গুলো কখনো কখনো প্রবল আকার ধারণ করে। তবু এই দ্বিতীয় পথ টাই বাছলাম আমি।
এই সমস্যা গুলো গোটা ট্রিপে অনেকেই ফেস করেছে। সেগুলো, এবং তার সাথে স্বর্গে র কাছাকাছি পৌঁছে যাবার আরো অনেক গল্প নিয়ে ফিরে আসবো আমি। অপেক্ষা য় থেকো সবাই।
এই ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন দোলা গুপ্তা। উনি এখনো রেজিস্ট্রি করেননি তাই প্রশান্ত পাবলিশ করেছে এই অতীব সুন্দর কাহিনীটা।