Home Blog

সিগারেট যখন প্রশ্ন করবে

0

সিগারেট যখন প্রশ্ন করবে

রণজিৎ বালা

সিগারেট যখন প্রশ্ন করবে
কেন পোড়াচ্ছিস?
আমাকে নয় নিজেকে।
চোখের পাতায় ক্লান্ত, বিভোর
ঘুম বিরক্ত হয়ে আনাগোনা করছে
রুখে দাঁড়াবে হয়তো।
মিথ্যে ভাষণে কান মগ্ন
হাত দুটো অবস,
কলম ধরার বৃথাই প্রয়াস
ঠোঁট থেতলে গেছে কথাদের ভিড়ে,
আমি আমারই আছি
ভেসে যায়নি গুজবে।

গোপন বাক্স

0

মৃত্যুর পর যদি একমাস বেঁচে থাকি
সে যেন হয় শুধু তোমার মনে
কোনো এক শীতের বিকেলে
অথবা ভরা বর্ষার সকাল,
নয়তো অসহনীয় গৃষ্মের দুপুরে
দুটো ভাঙা চেয়ারের একটায় বসে
গোপন বাক্সখানা খুলবে ধীরে ধীরে।

খিল খিল করে হেসে উঠবে তুমি
খালি বাক্স দেখে, মিষ্টি শব্দে ঘর ভাসবে
কী বোকা লোকটা, সব দিয়েছে সবারে
আমার জন্য খালি বাক্সটা শুধু।

তারপর উঠোনে কাপড় তুলতে গিয়ে হঠাৎ
দৌড়ে ফিরে যাবে সেই বাক্সের কাছে
চীৎকার করে বলবে, এই তো সব আছে,
সব তো আমার জন্যই রেখে গেছে!

যক্ষের ধন

0
ইচ্ছে করে ডাইসেক্ট করি তোমাকে
না না তোমাকে নয়, তোমার ভাবনাকে
খুন চেপে গেছে তোমার মাথায়
ব্যর্থ প্রথম প্রেমের অব্যক্ত ব্যথায়
অন্তর জ্বলে তোমার প্রতিশোধ স্পৃহায়
দেহ-মন তৈরী অন্তর্জলী যাত্রায়
শখ হয় টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলি
সব ভাবনা তোমার, আর ব্যথার ডালি
এক হাতে যায় না ভাঙা তোমার পুরোনো বাঁধন
আঁকড়ে রেখেছো তুমি তোমার যক্ষের ধন
কে আলগা করবে এ বাঁধন, নিঃশ্বাসে বিষ
তোমার, দুপায়ে তাই ঠেলেছো আশীষ
আমি ব্যর্থ হই, সময়ের পিঠে সময় চেপে
বেড়ায়, আমি শুধু চলি দুঃখের বোঝা মেপে

স্বপ্নের উপত্যকায় by দোলা গুপ্তা

1

স্বপ্নেরা তবু ছুঁয়ে যায়: দু বছরের ও বেশি সময় ধরে একটা স্বপ্ন ছুঁয়ে ছিল আমায়। হ্যা৺, এখনো তাকে স্বপ্ন ই বলবো আমি। কিছু কিছু স্বপ্ন পূরণ হবার পরে ও যেন ঘুমঘোর থেকে যায়। নিজেকে চিমটি কেটে জাগিয়ে তুলে জিজ্ঞাসা করতে হয়, যা দেখে এলাম তা কি সত্যি? না কি, স্বপ্নের ঘোর?
হিমাচল প্রদেশ এর লাহুল আর স্পিতি ভ্যালি। শীতল মরুভূমি। গ্ৰেটার হিমালয়ান রেঞ্জ এর বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত বলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত এর পরিমাণ খুব কম। কোন কোন জায়গায় বৃষ্টি প্রায় হয় না বললেই চলে। সম্পূর্ণ উপত্যকা র অধিকাংশ জায়গার উচ্চতা ১০০০০ এবং তার বেশি অলটীচ্যুড এ ঘোরাফেরা করে। বাতাসের চাপ এবং অক্সিজেন- দুটো ই বেশ কম। পথ দূর্গম। ধ্বসপ্রবণ। কোন কোন জায়গায় না থাকারই মতো। অথচ, ল্যান্ডস্কেপ এর এত বৈচিত্র্য আমি অন্য কোথাও দেখিনি। হিমালয় এর এই রূপ আমার আগে কোথাও চোখে পড়ে নি। চোখ আর মন জুড়ে বসেছিল ধূসর পাহাড়ের কোলে চন্দ্রতালের নীল জলের অপার্থিব সৌন্দর্য। ইউটিউব ভিডিও দেখতে দেখতে মন অস্থির হয়ে উঠতো। সাথে ছিল ফেবু তে দেখা ছবি, যদিও সংখ্যায় কম। দু’বার প্ল্যান করলাম। সফল হলো না। যাদের নিয়ে করলাম তারা হয়তো নিজেদের ওপর ভরসা রাখতে পারে নি।😀। ওই রাস্তায় গাড়ি তে সোলো ট্রিপ করার যা খরচ, তা আমার পকেট এর আয়ত্তের বাইরে। কাজেই আশা প্রায় ছাড়তে বসেছিলাম।
আজ যখন এই স্বপ্নের জার্নি টা নিয়ে লিখতে বসেছি, একজনের কথা না বললে খুব অন্যায় হবে। রাহুল। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। ওর কাছে প্রথম যখন নিজের স্বপ্নের কথা বলি, ও বিশ্বাস করেছিল আমায়। ভরসা করেছিল। একটা ট্যুরিজম কোম্পানির ওনার, বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট। কিন্তু বন্ধুত্ব আর বিশ্বাসের বেশ শক্তপোক্ত একটা সম্পর্ক কিভাবে যেন গড়ে উঠেছিল। কখনো এক পয়সার ও বিজনেস দিইনি আমি রাহুল কে। তবু বন্ধুত্ব নষ্ট হয় নি। এই জায়গাতে ও আমি রাহুলের কাছে কৃতজ্ঞ। সব সম্পর্ক যে দেওয়া নেওয়া র ওপর নির্ভর করে টিকে থাকে না, এটা ও আমি রাহুল কে দেখে ই বিশ্বাস করতে শিখেছি। ফেসবুক আমায় যে দু চারটে সৎ মানুষ উপহার দিয়েছে তার জন্য আমি ফেসবুক এর কাছেও কৃতজ্ঞ। এই লেখায় রাহুলের সম্পর্কে এতগুলো কথা বলার একটাই কারণ, ও ভরসা করেছিল আমার স্বপ্ন কে। আমার সমস্ত পাগলামি তে সায় দিয়েছিল নির্দ্বিধায়। আর আমি ভরসা করেছিলাম ওকে। এই বছর জুন মাসে কথাপ্রসঙ্গে স্পিতি ভ্যালি নিয়ে আমার স্বপ্ন, আমার মধ্যেকার অস্থিরতা শেয়ার করেছিলাম আমি। এই বছর জুনে ই ১৩ তারিখ স্পিতি যাবার সব প্ল্যান তৈরি ছিল আমার। কিন্তু বিধি বাম। করোনার কারণে দলের কেউই আর সাহস পেলো না ট্রিপ টা করার। ধন্য আশা কুহকিনী!!! তখনও আশায় বুক বেঁধে বসে আছি আমি। এই বছরের শ্রেষ্ঠ সময় টুকু সেপ্টেম্বর এর শেষ। যখন স্পিতি ভ্যালি র আকাশ সবচেয়ে নীল থাকে।‌বর্ষা শেষ হওয়ার পর প্রকৃতিও থাকে ঝকঝকে। আর বেশি কি চাই!!!! অতএব নতুন করে দল গড়ে তোলা শুরু করলাম। স্পিতি তে ঢোকার দুটো পথের মধ্যে একটা সিমলা থেকে কিন্নর হয়ে। এই পথ ধ্বসপ্রবণ, কিন্তু বিপন্মুক্ত। হাতে দুটো দিন এক্সট্রা থাকলে মসৃণ ভাবে স্পিতি ভ্যালি তে প্রবেশ করা যায়। তারপর কুনজুম পেরিয়ে মানালি হয়ে নিষ্ক্রমণ। স্পিতি সার্কিট বেশিরভাগ মানুষ এভাবেই কমপ্লিট করে। আমার জন্মলগ্ন থেকেই সব কিছু অস্বাভাবিক। তাই , কোনকালেই এই রুটে র কথা ভাবিনি আমি। আমার প্ল্যান ছিল মানালি দিয়ে ঢুকে মানালি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। সুবিধা দুটো। ১. সময় কম লাগে।
২. অবধারিত ভাবে খরচ ও কম হয়। অসুবিধা গুলো ও মারাত্মক। রোটাং লা পেরিয়ে গ্ৰামফু থেকে বাতাল পর্যন্ত পুরোটাই অফ রোড। কার্যত অনেক জায়গায় রাস্তা নেই। দ্বিতীয় অসুবিধা টি আরো সাংঘাতিক। AMS অর্থাৎ, acute mountain sickness. মানালি দিয়ে স্পিতি ভ্যালি তে ঢোকার সবচেয়ে বড় সমস্যা এটাই। এত high altitude পরিবর্তন অনেকের শরীর ই মানিয়ে নিতে পারে না। আর বাতাসে অক্সিজেন কম হবার জন্য উপসর্গ গুলো কখনো কখনো প্রবল আকার ধারণ করে। তবু এই দ্বিতীয় পথ টাই বাছলাম আমি।
এই সমস্যা গুলো গোটা ট্রিপে অনেকেই ফেস করেছে। সেগুলো, এবং তার সাথে স্বর্গে র কাছাকাছি পৌঁছে যাবার আরো অনেক গল্প নিয়ে ফিরে আসবো আমি। অপেক্ষা য় থেকো সবাই।

অভিমান

0

দেশ তো তোমার সঙ্গে করেছে খুনসুটি
ট্রেন চলে গেছে, লাইনে পড়ে আছে লাশ আর পোড়া রুটি।
কাজ নেই,দুবেলা দুমুঠো ভাত নেই,কে দায়ী!
চলে গেছ ভিনদেশে কাজ খুঁজে, তোমরা পরিযায়ী।

শ্রম যে দেয় সেই শুধু বোঝে,আর তার ঘাম
দেশ শুধু মাথা গোনে,ভোটে তার একমাত্র দাম।
জীবন যাপন করে যারা, পেটে নিয়ে ক্ষুধা
তারাই কেবল জানে, রাষ্ট্রে তার কতটুকু নাগরিক সুবিধা।

অভিযোগ এতটুকু নেই কিন্তু অভিমান একরাশ হয়
যখন জানতে পারে কি কি পাওয়ার ছিল, কি কি নয়।

সোনার পৈতা

0

বৌবাজারের গা ঘেঁষে উত্তর দিকে যে লম্বা গলিটা গেছে সেটা ধরে এগিয়ে গেলেই নাকি অফিসটা বাঁদিকে পরবে। আমি নিজেই যেতে পারতাম। লোকটা নাছোড়বান্দা। দুশ টাকার বিনিময়ে আমাকে নিয়ে যাবে। এটাই নাকি নিয়ম সেখানে। লোকটার পিছু পিছু হাঁটছিলাম। কথা বলা তো দূরের কথা পাশাপাশি হাঁটতেই কেমন যেন ঘেন্না করছিল। বলছিল আরও দুশ টাকা দিলে একদম পছন্দসই ‘মাল’ এনে দেবে। আমি বললাম, আপনি আমার সামনে থাকুন। আমি পিছু পিছু আসছি। দোকানপাট দেখতে দেখতে যাব। রাস্তার দুধারে সার দিয়ে দোকান। পান বিড়ির দোকান থেকে শুরু করে ফুলের দোকান। একটা দোকানে আবার ঠাকুর দেবতার ছবি ছিল অজস্র।

এবার আপনি আসতে পারেন। আপদ বিদায় করে ছোট্ট অফিস ঘরটাতে ঢুকে নিজেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লাম। টেবিলের অপর পাশে একজন গম্ভীর মুখ করে বসে আছে। ভাবখানা এমন যেন এক্ষুনি বৃষ্টি আসবে অথচ হাতে ছাতা নেই। হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছেন?” এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না; লোকে বরং বিরক্ত হয়। প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই জিজ্ঞেস করেন, “কী চাই বলুন?” বললাম, একটি প্রকল্পের ব্যাপারে কিছু তথ্যের প্রয়োজন ছিল।

এটা সেটা নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথা ঠিক নয়, প্রায় একতরফা অভদ্রতা যেন আমার তরফ থেকে। এমনটাই আমার মনে হচ্ছিল। কারণ ভদ্রলোক অনিচ্ছায় চিবিয়ে চিবিয়ে কিছু তথ্য দিচ্ছিলেন। যেন আমাকে দয়া করছেন। অথচ এনাদের কাজই হলো আবাসনের মেয়েদের জীবন ধারণে সাহায্য করা। আমিও সেই কারণেই তথ্যগুলো চাইছিলাম। ভালো কিছু প্রকল্প করতে গেলে অনেক তথ্যের প্রয়োজন। তথ্য থাকলে রিসোর্স এলোকেট করতে সুবিধা হয়। বিশেষ করে যখন সীমিত রিসোর্স থাকে। আমার অভদ্রতা আর ভদ্রলোকের বিরক্তি – এমন মধুর কথোপকথনের মাঝখানে হটাৎ করে একটি মেয়ে এসে একটা খবরের কাগজ নিয়ে পাশের টেবিলটার সামনে একটি চেয়ারে বসে পড়ল। আমি একবার তাকিয়ে আবার আমাদের কথায় ফিরে গেলাম।
তারপর আর খেয়াল করিনি। কথাবার্তায় মগ্ন ছিলাম। হঠাৎ কানে এল মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। আর ‘সোনার পৈতা সোনার পৈতা’ করে কী যেন বলতে চাইছে অথচ হাসির জন্য আর বলে উঠতে পারছে না। খানিকটা বিরক্ত হলাম। আসলে সামনের ভদ্রলোকের উপর যে বিরক্তিটা এতক্ষন ধরে জমা হচ্ছিল সেটাই উগরে দিলাম মেয়েটার উপর। জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে? এমন করে হাসছো কেন?” মেয়েটা একটু সাহস পেয়ে উত্তর দিতে চেষ্টা করলো, “একদিন ব্রা…পৈতা।…..”

কিছুতেই হাসি থামাতে পারছে না। বলবে কি করে? সামনের ভদ্রলোক এবার খিস্তি মেরে উঠল, “যা এখান থেকে। অসভ্য মেয়ে কোথাকার!” মেয়েটা হাসতে হাসতে চলে গেল। আমার আর জানা হলো হলো না কী নিয়ে যে এতো হাসি পেয়েছিল ওর।

বাড়ি ফিরে এলাম। বেশ বিরক্ত হয়েই। ভদ্রলোককে যে চটকানা মারতে ইচ্ছে হয়েছিল সে না বললে ভুল বলা হবে। কিন্তু এখন আর রাগ বা বিরক্তি নেই। এখন এক রাশ কৌতূহল হচ্ছে মেয়েটাকে নিয়ে। কী নিয়ে হাসছিল এত? দুটো শব্দই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম- ব্রা আর পৈতা। আরও কি সব বলছিল সেদিন যদি সোনার পৈতা…!” কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু ব্রায়ের সাথে পৈতার সম্পর্ক কি? ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছি সে আবাসনেরই মেয়ে। কেমন একটা জেদ চেপে গেল হঠাৎ। আমাকে জানতেই হবে কেন এমন করে হাসছিল!

(অসমাপ্ত)

ভারতবর্ষ

0
ইদানিং দুটো ঘটনা ঘটেছে যা ভারতবর্ষকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। মহুয়া মৈত্র যখন সাংবাদিকদের দুপয়সার সাংবাদিক বলেছিল তখন অনেকেই তার প্রতিবাদ করেছিল। অথচ পরপর দুটো ঘটনা প্রমান করে দিয়েছে ভারতবর্ষের সাংবাদিকরা সত্যিই দুপয়সার সাংবাদিক আর তারা দেশটাকে এক পয়সার ‘দেশ’ বানাতে বিন্দুমাত্রও দ্বিধা করে না।
ঘটনা ১. ক্রিকেটে পাকিস্তানের জয় এবং ভারতের হার। কাগজগুলো যে পরিমান পোস্ট দিয়েছে এবং যেভাবে দিয়েছে তা লজ্জাজনক তো বটেই তদুপরি মানসিক স্বাস্থ নিয়ে লোকেদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। খবরের পর খবর দিয়েছে ভারতের প্লেয়াররা কতটা খারাপ খেলেছে, কে কোন রেঙ্ক হারিয়েছে, কে কতটা কি মিস করেছে, ইত্যাদি। অর্থাৎ ভারত, ভারত, এবং ভারত। প্রতিটি ঘটনারই দুটো দিক থাকে। খেলাও ঘটনা বৈকি। ভারতের দু-পয়সার সাংবাদিকরা এটা মানতে নারাজ অথবা অবচেতন মনে দেখতে পাচ্ছে না যে পাকিস্তান ভালো খেলেছে বা ভালো খেলতে পারে। এটার মানে হলো পাকিস্তান কনস্ট্যান্ট (C ); ভারতই একমাত্র ভালো বা খারাপ খেলতে পারে অর্থাৎ ভ্যারিয়েবল (X ). এই ধারণাটা কোত্থেকে আসে জানেন? মেইনলি আসে সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকে। Somehow আমাদের মনে গেথে গেছে আমাদের প্লেয়াররা জগৎশ্রেষ্ঠ। তাদের চাইতে ভালো খেলোয়াড় হতেই পারে না। আরও একটা কারণে এটা আসে। সেটা হলো ঘৃণা। পাকিস্তানের প্রতি আমাদের ঘৃণা থেকে। ভালোবাসা নিয়ে একটা সুন্দর কথা আছে – ভালোবাসি, শুধু ভালোবাসি বলেই। কিন্তু এই কথাটাই পাল্টে নিয়ে ঘৃণার অবস্থান বোঝানো যায় না। এটা বলা যায় না – ঘৃণা করি শুধু ঘৃণা করি বলেই। তাহলে জীবনের মাহাত্ম বলে আর কিছুই রইলো না। খেলা তো খেলা রইলই না তদুপরি আবার বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের কিছু মানুষের সাথে হীন হবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে গেলাম। কিছুক্ষন আগে একটি পোস্ট দেখলাম পয়েন্ট টেবিলে ইন্ডিয়া নাকি নামিবিয়ারও নীচে? এটা কি মানা যায়। নামিবিয়া েকে তো আফ্রিকার ছোট একটা দেশ। তদুপরি কালোদের দেশ। এই সমস্ত ‘দুধের শিশুদেরও’ (কথাটা আমার নয়) নীচে? তা কি কখনো হতে পারে? ইজরায়েল বা ফ্রান্স থেকে যখন অস্ত্র কেনা হয় তখন সেই একই সুরে বলা হয় কি ভারত যে তাদের কত নীচে এবং কোন টেবিলে?
দুপয়সার সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন করা যাবে কি – জাপান জানি কয়টা সোনা পেয়েছে অলিম্পিকে? মেডেলের পুরো চার্টটা তাদের সামনে তুলে ধরে কিছু বলা যেতেই পারে কিন্তু তাদের সেই ইন্টেলেক্চুয়াল ক্যাপাসিটি আছে কি বোঝার?
ঘটনা ২. শাহরুখ খানের ছেলের ‘ড্রাগ’ নেওয়াকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত পোস্ট বা খবর বেরিয়েছে সাংবাদিকরা আবারো প্রমান করেছে তারা দুপয়সারই বটে। জামিন পাবার পর যেভাবে গাড়ীর পেছনে কুকুরের মতো ছুটেছে রা দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। ও কি সম্ভব? আরো অনেক কিছু বলার আছে। পরে না হয় আবার। …..

এখন যখের ধন

1

সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছিল ধারালো অস্ত্রগুলো, দল বেঁধে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল ভিন্নধর্মীদের সন্ধানে। ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ল তারা দোতলা বাড়িটার দরজায়। বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার রোল উঠল।
উল্লাসের সঙ্গে ধর্মের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে দলটা কিছু সময় পরে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে গেল আরও একটা বাড়ির সন্ধানে। এখন আর কোন আর্তনাদ, কাতরানি, কান্না, অনুনয় কিছুই নেই। রক্তের ধারায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষত বিক্ষত দেহগুলোয় প্রাণ নেই। পুরুষ তো বটেই, শিশুরাও রেহাই পায়নি, আর মহিলারা? প্রাণ বা মান কোনটাই তাদের বাঁচেনি।
কত শত বছর হয়ে গেল এই অন্ধকার পাতালপুরীতে যক্ষ হয়ে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদে ভরা কলসীগুলোকে। উপযুক্ত ব্যক্তিকে এই মহামূল্যবান সম্পদ হস্তান্তর করতে হবে। আজ অবধি কেউ আসেনি এই সম্পদের সন্ধানে।
ক্ষিধেয়, অসুস্থতায় অজ্ঞান হয়ে পথের ধারে পড়ে থাকা বৃদ্ধা জ্ঞান ফিরতে জানিয়েছিলেন তাঁর আপন সন্তান তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
সুড়ঙ্গ বেয়ে ক্রমেই আরো নীচে নেমে যাচ্ছিল পাঁচজনের দলটা। তারা শুনেছে সেই অমূল্য সম্পদে ভরা কলসীগুলোর কথা। গল্প শুনেছে বহুবারের ব্যর্থ অভিযানের। কেউই আজ অবধি পৌঁছতে পারেনি ওই গুপ্ত সম্পদের কাছাকাছি। এতদিন যাইই হয়ে থাক এখন এই সম্পদ উদ্ধার করতেই হবে যে করেই হোক। এই সম্পদ উদ্ধার না করতে পারলে সমূহ বিপদ। পৃথিবী আজ সম্পদশূণ্য।
সুড়ঙ্গের শেষে পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারা এগিয়ে গেল কলসীগুলোর দিকে। কলসীতে হাত দেওয়ার আগেই সেই পাতালগুহা কেঁপে উঠল বিকট অট্টহাসিতে। দলপতি কোনরকমে সাহস সঞ্চয় করে সামনে দাঁড়ান বিশালদেহী যখকে বোঝাতে লাগল কেন তাদের এ সম্পদ দরকার এখনি। সব শুনে বিস্ময়ে, লজ্জায়, দুঃখে যক্ষ ধূলো হয়ে ঝরে পড়া মাত্র তারা একে একে ভালবাসা, মমতা, কর্তব্যবোধ, সহিষ্ণুতা, মানবিকতায় ভরা কলসীগুলো তুলে নিল।

মোহিনী

0

শেষ বিকেলের আবছা আলোতে ঝুঁকে পড়ে একমনে হাতের ভাঙ্গা হাঁড়ির টুকরোটা দিয়ে আলতো করে পাতা মাটি সরাচ্ছিল, যদি গোল গোল আলুর মত ছাতুগুলো পাওয়া যায়। শালবনের পচা পাতার নীচে মাটির নীচে ছাতুগুলো এই সময়ে পাওয়া যায়। সকালে এলে ভাল হত কিন্তু নেকড়েটা তাকে জঙ্গলে ঢুকতে দেখলে আর রক্ষা আছে! কিছু ছাতু সে পেয়েছে, তুলে আঁচলে ভরেছে, আর কয়েকটা হলে মা বেটীর কুলিয়ে যাবে। উনিশ বছরের যৌবন ঢাকার মত পর্যাপ্ত কাপড় নেই, ছেঁড়া ফাটা গায়ে জড়ানো শাড়িটার আঁচলের আস্ত অংশটা ছাতু জমা করার কাজে লাগছে। দুলির ভাবনায় দুনিয়া চলে না, তাই দুলি যখন ঝুঁকে পড়ে ছাতু খোঁজায় মন দিয়েছে তখনই গাছের আড়ালে এতক্ষণ ধরে নাল ঝরিয়ে অপেক্ষা করা নেকড়েটা ঠোঁট চাটতে চাটতে বেরিয়ে এল।
চটকানো খামচানো দোমড়ানো মোচড়ানো দুলিকে ঘরে ফিরতে দেখে তার বিধবা মা’র কিছুই বুঝতে বাকি রইল না, ছুটলো মোড়লের কাছে তারই ছেলের নামে নালিশ করতে।
মোড়ল জানাল তার অভিযোগের বিচার হবে তবে তার আগে গাঁয়ের বাচ্চাদের যে রোজ জ্বর আসছে, হাত পা সরু হয়ে যাচ্ছে, জানগুরু তার নিদান দেবে তারপরেই।
পরদিন দুপুরে জানগুরু জানিয়ে দিল দুলি আর তার মা এই দুই ডাইনি গাঁয়ের বাচ্চাদের অসুখের জন্য দায়ী, গ্রামবাসীরাও জানাল তারা দুলি আর তার মা’র লোলুপ দৃষ্টি দেখে একথা আগেই অনুমান করেছিল। সুতরাং তাদের দুজনকে জ্যান্ত পুড়িয়ে গাঁয়ের বাচ্চাদের বাঁচাতে গ্রামবাসীদের উৎসাহের অভাব হল না। আগের সন্ধ্যায় নেকড়ের আঁচড় কামড়ে ক্ষত বিক্ষত দুলিকে তাদের ঘরের সঙ্গেই পুড়ে যেতে হল। দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারল না দুলির মা।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বাসরাস্তায় এসে একটা চলন্ত বাসও পেয়ে গেল। বেশ খানিক্ষণ পরে যেখানে নামল, সেখানে বাসরাস্তার একদিকে জঙ্গল আরেকদিকে ক্ষেত। এগিয়ে চলল বাসরাস্তার ধারের জঙ্গলের ভেতর। দাঁড়াল, এগোল, বসল, এগোল, হোঁচট খেল, পড়ল, উঠল আবার এগোল। মাটিতে মেশার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার লড়াইতে ব্যস্তকুঁড়ে ঘরটা পেয়ে তার মধ্যেই নিজেকে ঠেলে দিল সে।
কুঁড়ে আর সে টিঁকে গেল। গভীর রাতে দুলিইইইইইই দুলিইইইইইরে বলে মাঝে মাঝে বুকফাটা চিক্কুর ছাড়ে সে। সেই আর্তনাদ দহের ওপারের জঙ্গল পেরিয়ে গ্রামে পৌঁছতে জেগে থাকা বা ঘুম ভাঙ্গা গ্রামবাসী কেঁপে ওঠে।

“তারাশঙ্করের ডাইনি পড়া আছে?”
বাংলার ব্রজেনবাবুর প্রশ্নে অবাক হলেও, দীপক বলল, “নাইনে সিলেবাসে যেটুকু ছিল ওইটুকুই।
“ওতেই হবে ছাতিফাটার মাঠ নামটা পড়েছ তো?”
“তা পড়েছি”।
“এখানেও আছে, তবে নাম ছাতিফাটার মাঠ নয়, আর ডাইনি শুধু ওখানেই থাকে না গোটা অঞ্চলেই আছে। সাবধানে থেক বাপু” শিক্ষকরা কেউ শব্দ করে কেউ মুখ টিপে হাসল।
“এই নব্বুই সালে ডাইনি!” মনে মনে বলল দীপক। মুখে বলল, “আপনারা তো আছেনই।”
“তা আছি তবে সাবধানে থেক” বললেন অঙ্ক স্যর রেবতীবাবু।
মাথা নাড়ে দীপক। এই স্কুলের সব শিক্ষকই তার থেকে বয়সে বড়, কেউ বেশী কেউ কম। হেডমাস্টার মশাইয়ের সামনের বছর রিটায়ারমেন্ট।
বীরভূমের একরকম প্রত্যন্ত গ্রাম পাথরডুবির একমাত্র হাইস্কুলে চাকরিটা পাওয়ার পর একরকম নাচতে নাচতেই চলে এসেছে সে। কাল বিকেলেই এসে পৌঁছেছে, আপাতত হেডমাস্টারমশাইয়ের বাড়িতেই উঠেছে। আজ তার স্কুলে প্রথমদিন।
দিনটা স্কুলে ভালই কাটল দীপকের।
জানলা দিয়ে তাকাতেই চোখ পড়ল দোতলার বারান্দায় এক নারীমূর্তি। একটু অবাকই হল, এত রাতে ঐ বারান্দায় কে দাঁড়াবে! তার আজ বই পড়তে পড়তে কিছুটা দেরীই হয়েছে, তারপর রান্না চাপিয়েছে। দোতলার বারান্দার আলোয় ভাল দেখা যাচ্ছে না। পরনে শাড়ি বোঝা যাচ্ছে, মাথার চুলগুলো খোলা, দোতলায় এর আগে যে মহিলাদের দেখেছে, এ তাদের মধ্যে কেউ নয়। বাড়ির সবাই ভারিক্কী গিন্নীবান্নি মাঝ বয়সী। বয়স বোঝা যাচ্ছে না বটে তবে ছিপছিপে চেহারার এই মহিলা বাড়ির ওই তিন মহিলার কেউ নয় বোঝাই যাচ্ছে।
এই বাড়িতে সে উঠে এসেছে। এই অজ গাঁয়ে বাড়ি ভাড়া পাওয়াও মুস্কিল। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর শেষকালে জায়গা পাওয়া গেছে এই মহেশ রায়ের বাড়িতে। বাড়িটা প্রায় গ্রামের শেষ প্রান্তে, স্কুলটা এখান থেকে কাছে। রায়েরা এককালে বেশ বড়লোক ছিল, স্কুলটাও তার পূর্বপুরুষের তৈরি। গেটের ভেতর দোতলা বাড়িটার সামনেই পাঁচিলের ধার ঘেঁষে দেড়খানা ঘর, হয়ত চাকর বাকরদের জন্যে তৈরি হয়েছিল, এখন কেউ থাকে না। কীর্ণাহারে নিজের বাড়ি করার আগে স্কুলের ইংরাজী স্যর ভোলানাথবাবু এখানেই ভাড়া ছিলেন। প্রেসার কুকারের সিটির আওয়াজ আসতেই জানলা ছেড়ে স্টোভের দিকে এগোল সে। রান্নাঘর বলে আলাদা কিছু নেই ওই ছোট ঘর যেটা সেটাকেই সে রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করে।
স্টোভ নিভিয়ে আবার জানলার সামনে এসে দাঁড়াল। দোতলার বারান্দায় এখন কেউ নেই।
শুয়ে পড়া মাত্রই সে ঘুমিয়ে পড়ে আর এক ঘুমেই রাত কাবার হয়। ভোরে উঠে মর্ণিং ওয়াকে বের হয়। আজ কিন্তু ঘুমটা ভাল হল না। বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল আর যতবার তার ঘুম ভাঙ্গছিল, ততবারই মনে হচ্ছিল ঘরে সে ছাড়াও আরো কেউ আছে। আবছা ঘুমের মধ্যে তার কেবলই মনে হতে থাকল শাড়ি পরা কেউ তার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে কিছু বলতে চাইছে, এরকমটা যখনই মনে হচ্ছে তার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে, যদিও নাইট ল্যাম্পের হালকা আলোয় ঘরে যে সে ছাড়া কেউ নেই সেটাও বুঝতে পারছে।
যথারীতি ভোরের আলো ফোটার আগেই উঠে দাঁত মাজতে মাজতে রাতের ঘটনা নিয়ে ভাবতে গিয়ে একটা সহজ ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলল। কাল বিকেলে গিয়েছিল সেই মাঠটা দেখতে। সে হেডস্যার এবং অন্যদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছিল ওটার আসলে নাম ডুমুরদহের মাঠ। কোন এককালে ওখানে একটা জলা ছিল, তার নাম ছিল ডুমুরদহ। কালে কালে সে দহ বুঁজে গিয়ে মাঠের মত হয়ে যায়। আগে দহের চারদিকে যে জংলা মত ব্যাপারটা ছিল এখন সেই জঙ্গল আরো বেড়েছে। কেউই খোলসা করে বলেনি, তবে সবাই বলেছে জায়গাটা ভাল না। কেউ সেদিকে বড় একটা যায়ও না। সে ভূত প্রেত ডাইনি জ্যোতিষ তন্ত্র মন্ত্র কিছুতেই ভয় বা ভক্তি করেনা এমনকী ভগবানেও না। আসলে বাপ মা মরা ছেলে মামা মামীর সংসারে অনাদরে মানুষ হতে হতে এসবে ভয় বা ভক্তি করার অবকাশ পায় নি।
কাল বিকেলে চলে গিয়েছিল ওখানে, মাঠ বলে প্রায় কিছুই নেই, মাঝখানে কিছুটা বড় বড় ঘাস, উলুখাগড়া ভরা জমি, সেটাই বুঝি এককালে ঐ দহ ছিল আর তাকে ঘিরে পুরোটাই আগাছা, ঝোপঝাড় আর কিছু বড় গাছের জঙ্গল। বড় গাছ বলতেও সবই জংলী গাছ। জায়গাটা বেশ ছায়া ঘেরা ঠান্ডা ঠান্ডা। সত্যি কথা বলতে কী তার বেশ গা ছমছমই করছিল। আসলে সে ঐ জায়গায় গিয়ে পৌঁছতেই আচমকা কেমন একটা হাওয়া দিল। গাছের পাতায় একটা ঝিরিঝিরি শব্দ। কে যেন তার কানের কাছে কিছু ফিসফিসিয়ে বলল। চমকে তাকিয়ে দেখল আশে পাশে কেউ নেই। জায়গাটায় কুকুর গরু ছাগল তো দূর একটা কাক বা পাখীও নেই। হাওয়াটা থেমেও গেল প্রায় সাথে সাথেই। দহের ওপারের জঙ্গলটা আরো ঘন। ওই জঙ্গলের ওপারে বাস রাস্তা। সে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, কেন কে জানে গা ছমছম করলেও তার জায়গাটা খুব ভালোও লাগছিল। আবারো দমকা হাওয়াটা দিতে খুব মৃদু একটা মেয়েলী গলায় কেউ খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসি শুনে তার ভয় করল না, উলটে এতক্ষণের গা ছমছমানি ভাবটাও কেটে গেল। সে আরো ঢুকে এল জঙ্গলের ভেতর, বেশ খানিকটা এগিয়ে এল দহর দিকে, তার কানে নাকি মনের ভেতর কেউ যেন একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিল, “এস এস”। জঙ্গলে সাপ খোপ থাকতে পারে মনে হতেই সে পিছিয়ে এসেছিল। দ্রুত আলো পড়ে আসছে, ঘুরে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি এগোতে গেল, কিন্তু ঘোরার মুহূর্তে তার মনে হল যজ্ঞিডুমুর গাছটার পাশ দিয়ে কেউ দৌড়ে চলে গেল, একটা শাড়ির উড়ন্ত আঁচল যেন দেখতে পেল। সাথে সাথে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ভাল করে দেখল, নাঃ কোথাও কেউ নেই। পা চালিয়ে ঘরের পথ ধরল। সারাক্ষণ একটা অস্বস্তি হলেও সে কিন্তু জানতে পারেনি দহের ওপারে গাছের আড়াল থেকে দুটো তীক্ষ্ণ চোখ তার সাথে মোড়লের ব্যাটার মিল খুঁজে চলেছিল। গ্রামের রাস্তায় যেতে যেতে তার হাসিই পাচ্ছিল, ডাইনি, ‘ছাতিফাটার মাঠ’ কথাগুলো তার মনের ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছে ভেবে।
আজ এখনও হাসি পেল গোটা ঘটনাটা কাল রাতে তার ঘুমের বিঘ্ন ঘটিয়েছে দেখে।

মর্নিং ওয়াকের অভ্যাসটা এখানে এসেও বজায় রেখেছে। সবে আলো ফুটেছে, নরম আলো চরাচরে ছড়িয়ে পড়ছে, পাখপাখালির ডাকে ঝিরঝিরে হাওয়ায় বেশ লাগছিল, রাতে বৃষ্টি হয়েছিল ভালই, চারদিকের গাছগুলো একদম সতেজ, সদ্য স্নান সেরে আসা যুবতীর মাথার চুল বেয়ে গড়িয়ে এসে পড়া জলের ফোঁটার মত গাছগুলোর পাতা থেকেও থেকে টুপটাপ জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছে। শহুরে মানুষ গ্রামের এই পরিবেশে মুগ্ধ। তার থমকে যাওয়ার কারণ সামনের মেয়েটি, পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে গোড়ালি তুলে টগর ফুলের গাছ থেকে ফুল পাড়ছিল মেয়েটি, গাছটা রাস্তার ধারের একটা বাড়ির বেড়ার ওপারে আছে কিন্তু ডালগুলো কাঁচা রাস্তাটার ওপর এসে পড়েছে। একঢাল খোলা চুল কোমর ছাড়িয়ে নেমেছে, ছিপছিপে অথচ ভরাট শরীর, তার নজর গাছের দিকে, সে টেরই পায়নি দীপক দাঁড়িয়ে আছে। বেশীক্ষণ নয়, মেয়েদের একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে যা দিয়ে তারা খুব দ্রুত টের পেয়ে যায় যে কেউ তাদের দেখছে, এই মেয়েটাও পেল আর সরাসরি তাকাল দীপকের দিকে। মেয়েটা গাছের ডাল ছেড়ে দিয়ে খানিকটা সরে আসায় তার মুখটা স্পষ্ট দেখা গেল। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে দীপকের হৃৎস্পন্দন কয়েকগুণ বেড়ে গেল, তার মনে হল সমস্ত বিশ্ব চরাচর, সময়, সব থমকে দাঁড়িয়েছে, ওই দুটো চোখ থেকে তার চোখ সরাতেই পারছিল না। তার অবস্থা দেখে মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠতেই, লজ্জা পেয়ে দ্রুত চলতে শুরু করে দিল সে। প্রায় একমাস হতে চলল এ গাঁয়ে এসেছে, রোজই মর্নিং ওয়াকে যায়, সকালে স্কুলে যাওয়া বিকেলে ফেরা এছাড়া বিনা কারনেই গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়ান তার রোজকার রুটিন, কোনদিন মেয়েটাকে তো দেখেনি আগে! এমন সুন্দর দেখতে মেয়ে এ গ্রামে আছে সে আজই জানতে পারল, রঙটা একটু চাপা এই যা।
ঘরে ফিরে রান্না চাপিয়ে দিল। রান্না সে দুটোই জানে, হয় সব সেদ্ধ নয় খিচুড়ি আর ডিমভাজা। আজ খিচুড়ি আর ডিমভাজাই করল। স্কুলে যাবে বলে ঘর থেকে বেরিয়েই দেখল একটা যুবতী মেয়ে রায়বাড়ির দরজার সামনে তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে কিছু করছে। একেই তাহলে কাল রাতে দোতলার বারান্দায় দেখেছে। রায়েদের কোন আত্মীয় হবে, এসেছে গতকাল। শনিবার তাড়াতাড়ি ছুটি, বাড়ি ঢুকতেই যার সাথে ধাক্কা লাগছিল প্রায় তাকে দেখে বেশ অবাক হল। সকালের সেই ফুলচোর মেয়ে! তার দিকে কৌতুকের ঝিলিকভরা চাউনি দিয়ে মুচকি হেসে গেট খুলে বেরিয়ে গেল। ঐ চাউনি, ঐ হাসি দীপককে পাগল করে দিল। এই তবে রায়েদের আত্মীয়, কাল রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। বিকেল হতে না হতেই ডুমুরদহের মাঠ তাকে টানতে লাগল। আজ সেখানে পৌঁছে সবে একটু এগিয়েছে, তার মনে হল যজ্ঞিডুমুরের গাছটার আড়ালে কিছু একটা নড়ছে, এই সময় সেই দমকা বাতাসটা সেই খিলখিল মেয়েলী হাসিটাকে বয়ে নিয়ে এল আর সে মন্ত্রমুগদ্ধের মত এগিয়ে চলল। যজ্ঞিডুমুরের গাছটার কাছে গিয়ে সে একটা চমক খেল, গাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়েটি। তাকে দেখেই মেয়েটি খিলখিল করে চাপা গলায় হেসে উঠল।
“আপনি মহেশ রায় মহাশয়ের আত্মীয়?” নিজের ভোম্বলভাবটা কাটাতে কথা শুরু করে দীপক।
মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে, “রোজ এখানে আসেন?”
“রোজ নয়, কাল এসেছিলাম আর আজ। আপনার আসতে ভয় করল না?”
“কেন? ভয় করবে কেন?”
“ঐ যে গাঁয়ের লোক কতরকম কথা বলে!”
“ডাইনি?”
“হ্যাঁ, ওই আর কী……”
“আমাকে দেখে কি ডাইনি মনে হয়?”
“ধুর! কী যে বলেন! আমার নাম দীপক, আপনার নাম জানা হল না…”
“মোহিনী। মোহিনী ডাইনি” বলেই হেসে ওঠে মেয়েটা। কথায় কথায় সন্ধ্যে হয়ে আসে। দীপকের খুব ভাল লাগছিল কথা বলতে কিন্তু সন্ধ্যে নেমে আসায় ফিরতি পথ ধরে সঙ্গে মোহিনীও। আগের দিনের মত ফিরতি পথ ধরার সময় আজও একটা দমকা হাওয়া যেন ফিসফিস করে কী যেন বলে গেল।
সে একটু এগিয়ে চলছিল মোহিনী ছিল পেছনে, কিছুদূর এসে কথার উত্তর না পেয়ে পেছন ফিরে দেখল পেছনে কেউ নেই। গ্রামের মধ্যে দিয়ে তার সাথে যাওয়া বোধহয় ভাল দেখায় না, তাই মোহিনী কোনভাবে অন্য রাস্তা ধরেছে। ঘরে ফিরে দেখল তার ভাবনা সঠিক। মোহিনী দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
এরপর প্রতি বিকেলেই ডুমুরদহের মাঠে যাওয়া আর সেখানে মোহিনীর সাথে গল্প করা তার নেশার মত হয়ে উঠল। মাঝে মাঝে সন্ধ্যের পর সে যখন রান্না চাপায় তখনও মোহিনী তার ঘরে চলে আসে গল্প করে। রায়বাড়ির কেউ দেখলে বিপদ হতে পারে, এমন কথাকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেয় মোহিনী, কিন্তু মোহিনীর পরিচয় আজও জানা হল না। অবশ্য জানার জন্যে সে বিশেষ ব্যস্তও হয় না।
আজকাল কোন কাজেই মন বসে না। অষ্টপ্রহর মন জুড়ে থাকে মোহিনী। কখন বিকেল হবে, ডুমুরদহের মাঠে যাবে, মোহিনীর সাথে দেখা হবে, এই চিন্তাতেই বিভোর থাকে। চেহারাতেও পরিবর্তন আসে। উজ্জ্বল চোখ দুটোর কোলে কালি, শরীরটাও অনেক শুকিয়ে গেছে, তার ফর্সা রঙ যেন কেমন ফেকাশে হয়ে গেছে।
তার এই শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন নজর এড়ায় না কারো।
হেডস্যার একদিন বললেন, “খাওয়া দাওয়া মনে হয় ঠিকঠাক হচ্ছে না, আপনার চেহারা বেশ খারাপ হয়ে গেছে”।
ব্রজেনবাবু সরাসরিই বললেন, “কোথায় গ্রামের তাজা বাতাসে শরীর সারবে তা নয় উল্টে রোগা হয়ে যাচ্ছ! ডুমুরদহের মাঠের দিকে যাও না তো!”
মাঝরাতে বৃষ্টির ছাঁট গায়ে লাগতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাইরে প্রবল বৃষ্টি তার সাথে ঝড়, কী করে যেন দরজাটা খুলে গেছে। দরজা বন্ধ করতে উঠতেই ভীষণ চমকে উঠে দেখল তার পায়ের কাছে বিছানার এক ধারে বসে আছে মোহিনী।
“ক্‌ কী ব্যাপার?” তুতলিয়ে বলে দীপক।
হঠাৎই ফুঁপিয়ে ওঠে মোহিনী, “আমাকে কেউ দেখতে পারে না, পছন্দ করে না”।
মোহিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দীপক বলতে থাকে, “আমি আছি তো”।
মোহিনী দীপকের বুকে মাথা রাখতেই দীপক তার ভেতরে জলোচ্ছ্বাস টের পায়। প্রবল ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে মোহিনীকেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে দীপক।
পরদিন মেঘমুক্ত আকাশে ঝকঝকে আলো উঠলে দীপকের বিছানাতেই তার মৃতদেহটা পাওয়া যায়। প্রবল আতঙ্কে তার চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। দেখে মনে হচ্ছিল তার শরীরে যেন একফোঁটাও রক্ত নেই।
গভীর রাতে অনেকেই শুনেছিল ডুমুরদহের মাঠের দিক থেকে ভেসে আসা একটা অট্টহাসি।

সমাপ্তম

ব্রেন ডেথ

0

ব্রেন ডেথ

আজ বড্ড বেশি কুয়াশা পড়েছে। যদিও কার্শিয়াঙে শীত কালে, বিশেষতঃ ডিসেম্বর-জানুয়ারীতে যেমন জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়ে তেমনই পাহাড়ের প্রতিটা খাঁজ ঢেকে যায় কুয়াশার চাদরে। হাত ধরে একই সাথে হেটে চলা পাশের মানুষটিকে অব্দি স্পষ্ট দেখা যায় না! ফলে রাস্তায় যখন তখন দুর্ঘটনা ঘটার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। চলন্ত গাড়ির সামনে বা অপরিচিত রাস্তায়, হঠাৎ খাদের কাছে চলে আসা আশ্চর্যের না। ভোরের দিকে তো তাই সাধারণত কেউ বাইরে বেরোয় না।

গোপাল তামাং নামের এক নেপালী যুবক দ্রুত বাড়িটির বাগান পেরিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। একবার চারিদিকটা দেখার চেষ্টা করে যদিও কিছুই দেখা যায় না। ঠান্ডায় শরীরের হাড়গুলোতেও কম্পন ধরেছে। কিন্তু এটাই সঠিক সময়। পাঁচ মিনিটের পায়ে হাটা পথ। এরপরই সে নিজের গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। গত রাতে যেমন কেউ তাকে আসতে দেখেনি তেমনই ফিরে যেতেও কেউ দেখবে না। এই দুই মাস সে ওই গোলাপী ফুলের মধু নিংড়ে নিংড়ে খাবে এরপর তাকে ছুড়ে ফেলে দেবে। আবার যখন ইচ্ছেগুলো মাথা চারা দিয়ে উঠবে তখন নতুন শিকার খুঁজতে হবে তার। এসব ভাবতে ভাবতে গোপাল দ্রুত অথচ সন্তর্পণে নিজের বাড়ির দিকে পা চালায়। কিছুটা যেতেই হঠাৎ একটা মানুষের সাথে ধাক্কা খায়। গলার কাছে মনে হয় কিসের যেন হালকা কামড় অনুভূত হল! পিঁপড়ে কামড়ালে যেমন হয় তেমন।

“কে! কে?”

বলে হাতের মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটটা জ্বালাল ঠিকই কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। শুধু মনে হল, একটা ছায়া যেন সরে গেলো রাস্তার যে দিকটায় খাদ থাকার কথা, সেদিকে। সম্ভবত কোনো বৃদ্ধ ছিল। মানুষকে স্পষ্ট চেনা না গেলেও, সামনে থাকা একটা অবয়বকে বোঝা যায়। আর তার ফলেই
সেই কুয়াশার মধ্যেও লোকটার পিঠের কুঁজটা গোপালের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়ায়না।

বৃদ্ধ কিছুক্ষণ ধরেই ওর পেছনে আসছিল কিন্তু গোপাল অত গুরুত্ব দেয়নি। ভোরের আলো ফুটে গেছে। পাহাড়ের কর্মঠ মানুষগুলো একজন দু’জন করে নিজেদের কাজে বের হওয়া শুরু করছে।
গোপাল ততক্ষণে নিজের বাড়ির গেটে পৌঁছে যায়। গলার ব্যথাটা আর অনুভূত হয় না। সে বাড়ি ফিরে সোজা ঘুমোতে চলে যায়। সারা রাত মজা লুটেছে, এখন তার শরীর খুব ক্লান্ত। আবার রাতে যাবে তার কাছে। এখন একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।

সে রাতে গোপালের আর বাইরে বের হওয়া হয়না। যার সাথে অবৈধ সম্পর্কে নিজের জীবনের মজা নিচ্ছিল তার স্বামী ব্যবসার কাজ শেষ করে সময়ের পূর্বেই ফিরে এসেছে। ফলে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু গোপালের সেই অপেক্ষা আর শেষ হয়না! দু’দিন পরে হঠাৎ গোপালের জ্বর হয়। এরপর শুরু হয় মাথায় অমানুষিক ব্যথা এবং মাত্র দু সপ্তাহের মধ্যেই ব্রেন ডেড! ডাক্তাররা সন্দেহ করে ইনফেকশন থেকে ব্রেন ডেড হয়ে গোপাল মারা যায়। কিন্তু এরপর গোপালের পরিবারের মধ্যে ঘটতে থাকে এক অদ্ভুত ঘটনা!

**

“কি বলছেন স্যার? খুন! তাও সিরিয়াল কিলিং-এর ঘটনা!”

কনস্টেবল অখিল দেবনাথকে একবার দেখে নিয়ে ইন্সপেক্টর রুদ্রনীল বাগচী আবার তার ঔষধের কৌটো হাতে নিয়ে নাড়া চাড়া করতে থাকেন। ঔষধটা খাবার সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু সেটা খেলে মুকুন্দ বাবু আর আসবেন না। অথচ ওই মানুষটার খুব প্রয়োজন। ওঁর আই. কিউ আর পাঁচটা লোকের থেকে বেশি! অথচ সাইক্রাইটিস্ট রাস্তোগি রুদ্রনীলকে সাবধান করে দিয়েছেন, ইচ্ছাকৃত ওষুধ বন্ধ করে যদি নিজের আরেক রূপ মুকুন্দ দাসকে বারবার ডেকে আনেন তাহলে হয়তো একটা সময় রুদ্রনীলেরই কোনো অস্তিত্ব থাকবেনা!

রুদ্রনীল বাগচী মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছেন। তিনি নিজে একা কোনো কেসই সল্ভ করতে পারেন না। আর তাই তার আরেক রূপ মুকুন্দ দাস তাকে সেই কেস সল্ভ করতে সাহায্য করেন। ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য হলেও, চিকিৎসা শাস্ত্রে এমনটা হওয়া খুবই সাধারণ।

রুদ্রনীলের ভাবনায় বাধা পরে। কনস্টেবল অখিল তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। সে মুকুন্দ দাস, সাইক্রাইটিস্ট রাস্তোগি এদের কথা জানে না। কলকাতায় পোস্টিং হওয়ার পর থেকে অখিল তাঁর আন্ডারেই কাজ করে, তবে ওই থানা আর কাজের সূত্রেই দু’জনের যত কথা বার্তা। এর বাইরে নিজের একাকী জীবনে কি ঘটছে তা রুদ্রনীল কাউকে বলেন না। ছোটবেলায় অনাথ আশ্রমে বড় হয়ে ওঠা এই দুঁদে অফিসার যে এম.পি.ডি. অর্থাৎ মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছেন আর তার সেই দ্বিতীয় অবতারই হল মুকুন্দ দাস সেটা উনি নিজে
এবং সাইক্রাইটিস্ট রাস্তোগি ছাড়া কেউ জানে না। তবে রাস্তোগির দেওয়া ওষুধগুলো কন্টিনিউ করলে মুকুন্দ বাবুর আবির্ভাব ঘটনা ঠিকই কিন্তু তিনিই তো রুদ্রনীলের সমস্ত জটিল কেসগুলোর সমাধান করেন। সোজা কথায়, অনাথ আশ্রমে বড় হওয়ার দরুন তার মস্তিষ্কে প্রভাব পড়ে এবং উৎপত্তি হয় মুকুন্দ দাসের যে কিনা তাকে ছেলের মত ভালোবাসেন আবার চাকরি জীবনেও সমস্ত কেস সল্ভ করে দেন। আসলে রুদ্রনীল নিজেই সব করে কিন্তু তার মাথা সেটা মানতে চায়না। তাই তার মনে হয় মুকুন্দ দাসই কেস গুলোর জট ছাড়িয়ে দেন। এই যেমন দু’দিন আগে হঠাৎ খবরের কাগজে চোখ বোলাতে গিয়ে রুদ্রনীলের দৃষ্টি আটকে পড়ে একটি সমীক্ষায়। যেখানে বলা হয়েছে, কলকাতায় দিন দিন ব্রেন ডেথ-এ মানুষের অনেক মৃত্যু সংবাদ চিকিৎসকদের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবরটা প্রাথমিক দৃষ্টিতে তেমন কিছু না হলেও রুদ্রনীলের মনে হয় কোথায় যেন সে এই ব্রেন ডেথ নিয়ে একটি খবর পড়েছিল। সেদিন তার ভাবনায় ছেদ পড়ে যখন সে দেখে মুকুন্দ দাস সাত মাস পুরোনো একটা কাগজ এনে টেবিলের উপর সেটা মেলে ধরেন। যদিও সেখানে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি উপস্থিত থাকলে বুঝতে পারতো, রুদ্রনীল নিজেই খবরের কাগজটি বের করেছে কিন্তু তার অসুস্থ মস্তিস্ক তাকে যা বোঝায় সে সেটাই বোঝে। অর্থাৎ মুকুন্দ দাসের পারদর্শিতা আসলে রুদ্রনীলেরই কাজ!

সে যাই হোক, সেদিন কাগজটায় লেখাছিল একটি পরিবারের দুর্ভাগ্য জনক পরিণতির কথা। প্রকৃতির এমন পরিহাস যে একটি আপাতদৃষ্টিতে সুখী পরিবারের সকল মানুষ অর্থাৎ স্বামী, স্ত্রী এবং আঠারো বছরের ছেলে তিন জনেরই ব্রেন ডেথ হয়! ঘটনাটা নিঃসন্দেহে বিরল তাই কার্শিয়াঙ তো বটেই দক্ষিণ বঙ্গের খবরের কাগজে অব্দি সেই ঘটনা ছাপা হয়। আর তাই কলকাতার ব্রেন ডেথ এবং সেই পরিবারের ডেথ গুলোকে মনে মনে রুদ্রনীল বাগচী কানেক্ট করেই অখিলকে সিরিয়াল কিলিংয়ের সম্ভাবনার কথা জানায়। কিন্তু অখিল অবাক হয়। সে কার্শিয়াঙের ঘটনাটা জানেই না আর ব্রেন ডেথ কি করে খুন হতে পারে সে বিষয়ে তার মনে যথেষ্ট ধোঁয়াশা আছে। তাই রূদ্রনীল শেষে ঠিক করলেন মুকুন্দ দাসকেই আরো একবার ফিরিয়ে আনতে হবে।

রুদ্রনীল বাগচী ঔষধটা আর খেলেন না। অখিলকে বললেন,

“কার্শিয়াং-এ একটি পরিবারের এক অদ্ভুত গল্প মাস কয়েক আগে খবরের কাগজে পিড়েছিলাম।”

”কি গল্প স্যার?”

“সেখানে গোপাল তামাং নামের এক যুবকের
ব্রেন ডেথ হয়ে মারা যাওয়ার কিছুদিন পরেই তার কাকাতো দাদারও একই ভাবে মৃত্যু হয় এবং এর কিছুদিন পরে দাদার স্ত্রী এবং সন্তানও মারা যায় সেই একই ভাবে !”

“সে কি করে সম্ভব স্যার? যতদূর জানি ব্রেন ডেথ তো কোনো ছোঁয়াচে রোগ বা জীবাণুর সংক্রমণ না, যে কিছুদিনের ব্যবধানে পরিবারের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পরবে!”

“আমারও তখন খটকা লাগে তাই একটু খোঁজ খবর নিয়েছিলাম। তবে ওখানের পুলিশের থেকে যা ইনফরমেশন পেলাম তাতে খুনের কোনো তথ্য উঠে আসেনি। ডাক্তারের রিপোর্ট ওখানের পুলিশ আমাকে ফ্যাক্স করেছিল। সেটাও ভুয়ো বলে মনে হয়নি।”

“তাহলে কি আপনার মনে হচ্ছে বর্তমানে আমাদের শহরের ব্রেন ডেথ-এ মৃত মানুষগুলোর সাথে কার্শিয়াং-এর ওই পরিবারের মৃত্যুর কোনো যোগ সূত্র আছে?”

”সঠিক বলতে পারিনা। কিন্তু নিজের মত করে একটু তদন্ত করা প্রয়োজন। এমন না হয়, এক অতীব চালাক খুনি আমাদের চোখের সামনে একটার পর একটা খুন করে চলেছে আর পুলিশকে বোকা বানাতে সক্ষম হয়ে মনে মনে উল্লসিত হচ্ছে।

**

রুদ্রনীল সন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে বসে ভাবছেন, ব্রেন ডেড-এ মৃত্যুর ঘটনাগুলো হয়তো সাধারণ ঘটনাই। তিনি শুধু শুধু বেশি ভাবছেন। এমন সময় দরজায় কলিং বেল বাজলো। তাহলে কি মুকুন্দু দাস এলো!
রুদ্রনীল গিয়ে দরজা খুললেন। কিন্তু না, মুকুন্দবাবু নয়, অখিল এসে হাজির হয়েছে!

“কি ব্যাপার অখিল? তুমি এই সময় এখানে!”

“হ্যা স্যার। আপনার কথা মত শিলিগুড়ির টিকিট কেটে এনেছি। ট্রেনের টিকিট আনতে যাচ্ছি হঠাৎ ডি. এস. পি. স্যার থানায় এসে বললেন আপনাকে প্লেন-এর টিকিট করে দিতে। আপনি নাকি উনার সাথে ব্রেন ডেথ কেস নিয়ে আলোচনা করেছেন,
আর তখনই উনার মনে হয়েছে যত দ্রুত সম্ভব আপনার কার্শিয়াং পৌঁছনো দরকার। তাই প্লেনের টিকিট কাটা।”

রুদ্রনীল কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে থাকেন। তিনি নিজে আজ সারা দিনে না তো ডি. এস. পি. স্যারের সাথে কথা বলেছেন আর না তো অখিলকে কোনো টিকিট কাটতে বলেছেন! তার মানে মুকুন্দ দাস ফিরে এসেছেন এবং তিনিই এই কাজগুলো করেছেন। আর সবাই ভাবছে রুদ্রনীল করেছেন। সত্যি সত্যি কোনো খুনের ঘটনা যদি হয়ে থাকে এবং তার সমাধান তিনি করতে পারেন, তাহলে বরাবরের মত মুকুন্দ বাবু সব করলেও নাম হবে রুদ্রনীলের।

অখিলকে বিদায় দিয়ে রুদ্রনীল শুয়ে পড়েন। পর দিনই তাকে শিলিগুড়ি যেতে হবে। বলাই বাহুল্য বিনা টিকিটে মুকুন্দ বাবুও সঙ্গে যাবেন।

**

বাগডোগরা এয়ারপোর্টে ফ্লাইট থেকে নেমে রুদ্রনীল বাগচী একটা সাফারি ভাড়া করে নেয়। এই ধরণের অনেক গাড়ি এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। কার্শিয়াং, দার্জিলিং, গ্যাংটক এই সমস্ত পাহাড়ী অঞ্চল গুলো দেখতে বছরের প্রায় সব সময়ই টুরিস্টের আনাগোনা লেগেই থাকে। যারা বিত্তবান তারা এয়ারপোর্ট থেকেই গাড়ি ভাড়া করে নেয়। রুদ্রনীল বাগচীর অবশ্য টাকা ওড়ানোর কোনো রকম ইচ্ছেই নেই। উনার মিশনটা গোপন রাখার উদ্দেশ্যেই এই ব্যবস্থা।

বাগডোগরা থেকে শিলিগুড়ি ঢোকার মুখে গাড়ি বাঁ দিকে ঘুরে সোজা চলতে লাগলো। শুকনার জঙ্গল পেরিয়ে সেবক থেকেই শুরু হয়ে যায় পাহাড়ে চড়া। যতই উপরে উঠছে পাহাড়ের সৌন্দর্য্যে রুদ্রনীল যেন অবাক হয়ে যাচ্ছেন। তিনি কখনো পাহাড় দেখেন নি। একদিকে পাহাড়ের গা বেয়ে কত নাম না জানা গাছের জঙ্গল, আরেক দিকে খাদ। নিচে সবুজ তিস্তা নদী। আর কিছুদূর পর পর ছোট ছোট ঝর্ণা পিচ ঢালা রাস্তা ভিজিয়ে লাফিয়ে পড়ছে পাশের খাদে।
এই দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ বিকেল ফুরিয়ে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে পাহাড়ের বুকে। তখনও উঁচু চূড়ায় সোনালী আলো ঝলমল করছে। সে এক নৈসর্গিক দৃশ্য! এরপর সব অন্ধকার।

রুদ্রনীল যখন কার্শিয়াং পৌঁছলেন তখন রাত ৮টা। কিন্তু মনে হয় যেন গভীর রাত। সে সময় হোটেল থেকে আর না বেরিয়ে পরদিন খোঁজ খবর নেবেন বলে ঠিক করেন। লোকাল পুলিশের সাথে একবার দেখা করা প্রয়োজন।

**

“এগুলো কি?”

“এই হল গোপাল তামাং-এর ঠিকানা। আর এই হল সেই বস্তু যা কিনা সবার চোখের সামনে থেকেও কেউ আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি।”

”আপনি এগুলো কোথা থেকে জোগাড় করলেন?”

“কোথা থেকে আবার? কাল রাতে পুলিশ স্টেশন-এ গিয়েছিলাম।”

“আপনাকে ওরা এইসব এভিডেন্স-এর ফটো দিয়ে দিলো?”

“হ্যা কারণ এখানে ওই তমাল নামের ছেলেটার কলকাতা থেকে বদলি হয়েছে। আমাকে দেখেই সেলাম ঠুকে আমি যা যা জানতে চাইলাম সব বলে দিলো।”

রুদ্রনীল জানেন মুকুন্দ বাবুর কোনো অস্তিত্বই নেই। নিজের আরেক রূপ যাকে তিনি নিজের থেকে উন্নত মানেন তাকেই তিনি হ্যালুসিনেট করেন। অথচ তাঁর মন মানতে চায় না। এখন মুকুন্দ বাবুর কথায় তিনি বুঝতে পারেন যে, রাতে রুদ্রনীল একাই গিয়েছিলেন পুলিশ স্টেশনে এবং কলকাতায় তাঁর থানা থেকে বদলি হওয়া তমাল নন্দী তাঁকে দেখেই সব বলে দিয়েছে।

এবার তিনি টেবিলের উপরে রাখা নাম গুলো দেখে নেন।

“গোপাল তামাং, মৃত কারণ ব্রেন ডেড। তার দাদা রূপম তামাং, বৌদি শ্রেয়া তামাং এবং রূপম তামাং ও শ্রেয়া তামাং-এর এক মাত্র পুত্র কুশ তামাং, সকলের মৃত্যু ব্রেন ডেড!”

কথাগুলো বিড়বিড় করে মুকুন্দ দাসের দেওয়া সেই ছবিতে রুদ্রনীলের চোখ যায়। একটা লম্বা কন্টেনারের ছবি। সম্ভবত কোনো কেমিক্যাল বা ওই জাতীয় জিনিস এর মধ্যে প্রিসার্ভ করে রাখা হয়। এই জিনিসটা পুলিশ গোপাল তামাং আর রূপম তামাংয়ের বাড়ির আশেপাশে পেয়েছে। মোট চারটে এমন কন্টেনার পাওয়া যায়। তবে পুলিশ বোঝেনি সেগুলোর ব্যবহার কেন করা হয়েছিল। জিনিসগুলো নিয়ে কোনো সন্দেহই পুলিশের হয়নি। মুকুন্দ দাস বলেন,

“যদি তখনই কন্টেনারগুলোর ল্যাব টেস্ট করানো হতো, তাহলেই বোঝা যেত, এগুলো খুন কিনা।”

“আপনি নিশ্চয়ই কিছু আঁচ করতে পেরেছেন।”

রুদ্রনীলের কথায় মুকুন্দ দাস হাসেন। এরপর বলেন,

“একবার রূপম তামাংয়ের বাড়ির কাছাকাছি কিছু মানুষকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। আর তুমি অখিলকে ফোন করে বলো সমস্ত হাসপাতাল গুলোয় একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে, ব্রেন ডেড কেস গুলোয় রোগীর উপসর্গ কি ছিল। আমাদেরও একবার এখানের হাসপাতালে যেতে হবে। তুমি তমালকে একবার ফোন করে নিও। ওর ফোন নাম্বার তোমাকে না জিজ্ঞেস করেই তোমার মোবাইলে সেভ করে দিয়েছি।”

**

“কে! ওই শ্রেয়া তামাং? অমন চরিত্রহীনা মেয়ে মানুষের ওই পরিণতি হয়।”

রূপম তামাং-এর বাড়ির আশেপাশে খোঁজ খবর নিতে গিয়ে, তার প্রতিবেশী এক বাঙালি ভদ্র মহিলার থেকে যা জানা গেলো তাতে রুদ্রনীলের তেমন কোনো সন্দেহ না হলেও মুকুন্দ বাবুর মুখে একটা খুশীর ভাব প্রকাশ পায়। রুদ্রনীল সেই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন,

“উনারা কেউ বেঁচে নেই, তাই বুঝি যা ইচ্ছে তাই মন গড়া কথা রটাচ্ছেন?”

মহিলা এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন,

“মিথ্যে কেন রটাবো? এখানে যাকে জিজ্ঞেস করবেন সেই বলবে, গোটা পরিবারটি নোংরা ছিল। শ্রেয়ার বর রূপম বাড়ি থাকতে শ্রেয়ার এক বন্ধু এখানেই পড়ে থাকতো। আর রূপম বাইরে গেলে, দেওর গোপাল আসত রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আর বেরিয়ে যেত ভোরের কুয়াশার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে। ভাবতো কেউ দেখতে পারছে না। কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ না।”

মুকুন্দবাবু রুদ্রনীলকে বলেন,

“ওকে জিজ্ঞেস করো শ্রেয়ার সেই বন্ধুর নাম কি?”

মহিলা যেন সত্যি সি সি টি ভি! শুধু নামই না, শ্রেয়া তামাং-এর সেই বন্ধুর ফোন নম্বর এমনকি সে কোথায় থাকে, কি কাজ করে, সব বলে দিলেন! রুদ্রনীল ফিরে যাচ্ছিলেন। সেই মহিলা তাকে থামিয়ে আবার বললেন,

“শেষের দিকে নোংরামোর সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এক দিন ভোরে তো দেখি, বাড়ি থেকে তিন জনই মানে গোপাল, রূপম আর শ্রেয়ার বন্ধু এক এক করে বেরোচ্ছে। প্রথমে গোপাল, তার পেছনে শ্রেয়ার বন্ধু পলাশ আর একদম শেষে তার স্বামী রূপম। ছি ছি, শেষে কিনা পুরো রাত ৩টে পুরুষ মানুষের সাথে…”

মহিলা বলে চলেছেন কিন্তু মুকুন্দ দাস আর দাঁড়ায় না। রুদ্রনীলকে নিয়ে প্রথমে শ্রেয়ার বন্ধুর বাড়ি পৌঁছয় এরপর সেখান থেকে রুদ্রনীল কলকাতায় কিছু দরকারি টেলিফোন করে, ওরা লোকাল হাসপাতালে পৌঁছয়। সেখানে পৌঁছে চিন্তিত মুখে রুদ্রনীল হাসপাতালে খোঁজ নেওয়া শুরু করেন। গোপালের তেমন কোনো উপসর্গের কথা না জানা গেলেও শ্রেয়া, রূপম এবং কুশের ক্ষেত্রে মৃত্যুর কিছুদিন আগে জ্বর এসেছিল বলে জানা যায় এবং জ্বরের কিছুদিন পরেই তাদের মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হয়। ডাক্তাররা কোনো ইনফেকশন হয়েছে বলে ধারণা করে কিন্তু সমস্ত টেস্ট করার পূর্বেই হঠাৎ করে তাদের মৃত্যু ঘটে।

বিকেলে অখিল ফোন করে জানায় গত কয়েক মাসে কলকাতায় যত গুলো ব্রেন ডেড এর ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে অন্তত ৩৫ জনের জ্বর, মাথা ব্যাথা ছিল।
তাদের মৃত্যুর পর ডাক্তারদের মনে হয়েছে কোনো ইনফেকশন থেকেই ওই মানুষগুলোর মস্তিস্ক হঠাৎ মৃত হয়ে যায়। কিন্তু তাতে কোনোরকম খুনের অ্যাঙ্গেল বা সন্দেহ করার মতো কিছুই ছিল না। এই পয়েন্টটা শোনার পরই রুদ্রনীল কলকাতায় ফিরে আসেন । কলকাতায় এসে পুলিশের ইনফর্মারদের অ্যাকটিভ করা হয়। জানা যায়, নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েরা বা রিকশা চালক অথবা ট্রেনে বাসে প্রতিদিন যাতায়াত করে এমন মানুষদের শরীরেই সেই ইনফেকশন হয়ে তারা ব্রেন ডেড এর কারণে হঠাৎ মারা যায়।

রুদ্রনীল অখিলকে একটি ফোন নাম্বার দিয়েছিলেন।
সেই নাম্বারটি অ্যাকটিভ না থাকলেও সেটা যেই ফোনে ব্যবহৃত হতো সেই ফোনে, অন্য কোন নম্বর বর্তমানে সচল আছে তা জেনে, সেই নতুন নাম্বারকে ট্র্যাকিং-এ ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

**

কলকাতার রাস্তায় ফুটপাথও কিছু মানুষের বাসস্থান! দারিদ্রতার এ এক ভয়ঙ্কর রূপ যেখানে শতাধিক মানুষ রাতে রাস্তার ধারেই ঘুমিয়ে পরে। কখন যে কোনো অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি, প্রচন্ড গতিতে ছুটে এসে ঘুমের মধ্যেই তাদের জীবনের সমস্ত সংঘর্ষের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দেবে, তা তারা নিজেও জানে না। এই ফুটপাথ নিয়েও তাদের সংঘর্ষ করতে হয়। এই যেমন ওই ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলোর পাশে হঠাৎ কুঁজো মত এক নতুন আগন্তুক এসে দাঁড়িয়েছে। সে ধীরে ধীরে হাটু মুড়ে বসে, সম্ভবত সেই রাতটা ওখানে ঘুমোতে চায়। এরপর আরো এক রাত, এমন করে ফুটপাথের ওই জায়গাটুকুর দখল হবে তার। কিন্তু নতুন আর একজনকেও এই জায়গা ছেড়ে দেওয়া যায়না। শুয়ে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে যার পাশে সেই আগন্তুক এসে দাঁড়িয়েছিল সেই ব্যক্তি হঠাৎ উঠে বসে এবং আগন্তুককে তাড়িয়ে দিতে যায়। কিন্তু আগন্তুক ততক্ষণে তার পিঠে হাত দিয়ে কি একটা বের করে এনে ফুটিয়ে দিয়েছে হত দরিদ্র মানুষটার শরীরে।

সামান্য একটা পোকা কামড়ানোর মত ব্যাথা অনুভূত হয় লোকটার কিন্তু লোকটা বেজায় চোটে গিয়ে বাকিদের ডেকে তোলে। সেই আগন্তুক পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু মানুষগুলো তাকে ঘিরে ধরে। লোকগুলোর কেউই ফুটপাথটা আরেকজনের সাথে ভাগ করতে চায়না। তার উপর সেই অতর্কিত আক্রমণের ফলে তারা সমবেত হয়ে আগন্তুককে মারতে যাচ্ছিল এমন সময় পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ায়! গাড়ি থেকে নেমে আসে ইন্সপেক্টর রুদ্রনীল বাগচী(ক্রাইম ব্রাঞ্চ) এবং কনস্টেবল অখিল। বলাই বাহুল্য সবার চোখের আড়ালে থেকে মুকুন্দ দাসও এসে দাঁড়িয়েছে রুদ্রনীলের পাশে। রুদ্রনীল সেই আগন্তুককে পলাশ বলে সম্বোধন করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু মুকুন্দ বাবু ভুলটা ধরিয়ে দিলেন। তিনি ইন্সপেক্টর বাগচীর কানে কানে বললেন,

“ও পলাশ না। পলাশের বন্ধু অভীব্রত পাল। বাঙালি ছেলে। এন. আই. ভি. পুনেতে কর্মরত। বাকিটা পরে বলছি। একে গ্রেফতার করো এবং ওই লোকটিকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। না হলে, ওকেও ব্রেন ড্যামেজ হওয়া থেকে বাঁচানো যাবে না।”

**

লকআপে ইন্টারোগেট করার আগে মুকুন্দবাবু অভীব্রতর বিষয়ে যা যা ইনফরমেশন তার খবরীদের থেকে জেনেছিলেন সেগুলো রুদ্রানীলকে বলে দেন। এরপরের গল্পটা রুদ্রনীল নিজেই মনে মনে গুছিয়ে নিয়েছেন।

“তোমার নাম অভীব্রত পাল? পুনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন অফ ভাইরোলজিতে কাজ করো?”

“হ্যা।”

“পিঠে যেটা কুঁজ মনে হয় সেটা আসলে একটা কন্টেনার?”

“হ্যা।”

“কোন ভাইরাস সুরক্ষিত রাখো ওর মধ্যে?”

অভীব্রত এবার চুপ করে থাকে। অখিল পাশ থেকে চেঁচিয়ে ওঠে,

“স্যারের প্রশ্নের উত্তর দে। না হলে মেরে তোর সব হাড় ভেঙে দেব।”

রুদ্রনীল নিজেই শান্ত গলায় বলতে থাকেন,

“এইচ. এস. ভি. ভাইরাস থেকে এনকেফ্যালাইটিস হতে পারে এবং তার থেকে ব্রেন ড্যামেজ বা ব্রেন ডেথ?”

অভীব্রত উত্তর দেয়,

“হুম। সবই দেখি জানেন!”

“কিন্তু সেটার কোনো গ্যারান্টি নেই তাহলে কি করে সিওর হলে ব্রেন ডেথই হবে?”

এবার অভীব্রতর মুখে শয়তানি হাসি খেলে যায়। সে নিজের মহত্ত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে রহস্যের সব জটই খুলে দেয়।

“এইচ.এস.ভি ওয়ান এবং টু নিয়েই আমরা এতদিন জানতাম কিন্তু আমি পুনেতে রিসার্চ-এর সময় নতুন
এইচ.এস.ভি. থ্রি-এর আবিষ্কার করতে সক্ষম হই। সিওর ছিলাম না, এই ভাইরাস কি করতে পারে তা নিয়ে। তাই পলাশকে দিয়েছিলাম। জানেন ও ওই শ্রেয়াকে খুব ভালোবাসত। কিন্তু রূপমের সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ওর মনটাই ভেঙে যায়। শ্রেয়া কিন্তু ওর সুযোগ নিতে কখনোই ছাড়েনি। গোপালের সাথে অবৈধ সম্পর্কের থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো, তখন পলাশকে বলল গোপালকে শেষ করে দিতে। আর আমার বন্ধু অমনি রাজি হয়ে গেলো! আমি তখন সুবর্ণ সুযোগ পাই আমার আবিষ্কারের পরীক্ষার। পলাশ এক কুয়াশা মাখা ভোরে গোপালের শরীরে ঢুকিয়ে দিলো এইচ.এস.ভি থ্রি-কে। ব্যাস, চারদিনের মাথায় জ্বর আর চোদ্দদিন পরে মৃত্যু!”

অভীব্রত থামলো। অখিল অবাক হয়ে শুনছিল। রুদ্রনীল এবার বাকিটা বললেন,

“সেই ভোরে রূপম তামাং ফিরে এসে দেখে বাড়ি থেকে তার ভাই গোপাল এবং তার পিছু পিছু পলাশ বেরিয়ে যাচ্ছে। তিনি ওদের পিছু নিয়ে পলাশকে গোপালের শরীরে ইনজেকশন ফোটাতে দেখেন। ফলে পলাশ একদিন সুযোগ বুঝে রূপমকেও মেরে ফেলে, সেই একই ভাবে। শ্রেয়াকেও তার অসহ্য লাগতে থাকে তাই তাকে এবং তার ছেলেকেও ছাড়ে না। এরপর তোমরা দু’জন এখানে চলে এসে শুধুমাত্র খুন করার নেশায় একটার পর একটা খুন করে চলেছ। পলাশ কোথায় অভীব্রত?”

অভীব্রত এতগুলো খুনের দায় বিনা দ্বিধায় নিজের উপর নিয়ে নিলেও পলাশের কোনো খোঁজ দেয়নি। সে যে মানসিক ভাবে অসুস্থ তা তার এই হঠকারী ব্যবহারেই বোঝা যায়। সে ঠিক করেছে পলাশের খবর সে দেবে না। পুলিশ তাকে খুঁজে নিক। এটা তার পুলিশকে ছোড়া এক প্রকার চ্যালেঞ্জ। পুলিশ পলাশের ফোন থেকেই অভীব্রত অব্দি পৌঁছয় কিন্তু রুদ্রনীল বাগচী এমনকি তার থেকে বেশি আই.কিউ সম্পন্ন তার অপর সত্ত্বা মুকুন্দ দাসও কোনোদিন পলাশকে জীবিত বা মৃত খুঁজে পায়নি।

লকআপ থেকে বেরিয়ে এসে অখিল জানতে চায়,

“স্যার আপনি কি করে এত কিছু জানলেন? মৃত্যুগুলোতো সাধারণই মনে হচ্ছিল অথচ আপনি সেখান থেকে খুনের অ্যাঙ্গেল এবং খুনিকেও ধরে ফেললেন!”

“একজনকে ধরেছি, আরেক জন তো এখনো অধরা।”

“সে যাই হোক, এই বা কম কি?”

রুদ্রনীল মুকুন্দ দাসকে আর দেখতে পেলেন না। অনিচ্ছাকৃত ভাবেই সমস্ত ক্রেডিট নিজের নামেই নিতে হল। মুকুন্দ দাসের কথা বলে তিনি নিজেকে পাগল প্রতিপন্ন করতে চান না।

“কার্শিয়াঙের ঘটনাটা আগেই পড়েছিলাম হঠাৎ চোখে পড়লো সেই সমীক্ষা যেখানে বলা হয়েছে
গত কয়েকমাসে কলকাতায় এতগুলো মানুষ ব্রেন ড্যামেজ হয়ে মারা গেছে। একটা খটকা লাগলো এরপর কার্শিয়াং গিয়ে জানতে পারলাম শ্রেয়া, রূপম, গোপাল এবং পলাশের কথা। কিছু কিছু ঘটনা তখনই পরিষ্কার হয়ে গেল। পলাশের পুরোনো নাম্বারটা বদলে ফেললেও সে মোবাইল ফোনটা বদলায়নি। ফলে সেই মোবাইল ট্র্যাক করে তার নতুন নাম্বার পেয়ে গেলাম। এরপর টেলিফোন অফিস থেকে আমার এক খবরী খোঁজ দিলো, পলাশের নাম্বারের সাথে আরো একটি নাম্বার একই স্থানে বেশিরভাগ সময় অ্যাকটিভ থাকে। জানতে পারলাম সে অভীব্রত, পলাশের বন্ধু এবং ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্টে কর্মরত। এরপর একটু পড়াশোনা, ব্যাস কেস সল্ভড। অখিল অবাক হয়ে শুনলো। সত্যি তো, এ যেন জলভাত! সে চেষ্টা করলেও হয়তো সমাধান করতে পারতো। শুধু প্রয়োজন ছিল, রুদ্রনীল বাগচীর মত আরেকটু উন্নত মস্তিষ্কের।

(রুদ্রনীল বাগচীর এটা দ্বিতীয় গল্প তাই তার এবং মুকুন্দ দাসের বিষয়ে একটু বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে)

Recent Posts