Home গল্প মোহিনী

মোহিনী

350
0

শেষ বিকেলের আবছা আলোতে ঝুঁকে পড়ে একমনে হাতের ভাঙ্গা হাঁড়ির টুকরোটা দিয়ে আলতো করে পাতা মাটি সরাচ্ছিল, যদি গোল গোল আলুর মত ছাতুগুলো পাওয়া যায়। শালবনের পচা পাতার নীচে মাটির নীচে ছাতুগুলো এই সময়ে পাওয়া যায়। সকালে এলে ভাল হত কিন্তু নেকড়েটা তাকে জঙ্গলে ঢুকতে দেখলে আর রক্ষা আছে! কিছু ছাতু সে পেয়েছে, তুলে আঁচলে ভরেছে, আর কয়েকটা হলে মা বেটীর কুলিয়ে যাবে। উনিশ বছরের যৌবন ঢাকার মত পর্যাপ্ত কাপড় নেই, ছেঁড়া ফাটা গায়ে জড়ানো শাড়িটার আঁচলের আস্ত অংশটা ছাতু জমা করার কাজে লাগছে। দুলির ভাবনায় দুনিয়া চলে না, তাই দুলি যখন ঝুঁকে পড়ে ছাতু খোঁজায় মন দিয়েছে তখনই গাছের আড়ালে এতক্ষণ ধরে নাল ঝরিয়ে অপেক্ষা করা নেকড়েটা ঠোঁট চাটতে চাটতে বেরিয়ে এল।
চটকানো খামচানো দোমড়ানো মোচড়ানো দুলিকে ঘরে ফিরতে দেখে তার বিধবা মা’র কিছুই বুঝতে বাকি রইল না, ছুটলো মোড়লের কাছে তারই ছেলের নামে নালিশ করতে।
মোড়ল জানাল তার অভিযোগের বিচার হবে তবে তার আগে গাঁয়ের বাচ্চাদের যে রোজ জ্বর আসছে, হাত পা সরু হয়ে যাচ্ছে, জানগুরু তার নিদান দেবে তারপরেই।
পরদিন দুপুরে জানগুরু জানিয়ে দিল দুলি আর তার মা এই দুই ডাইনি গাঁয়ের বাচ্চাদের অসুখের জন্য দায়ী, গ্রামবাসীরাও জানাল তারা দুলি আর তার মা’র লোলুপ দৃষ্টি দেখে একথা আগেই অনুমান করেছিল। সুতরাং তাদের দুজনকে জ্যান্ত পুড়িয়ে গাঁয়ের বাচ্চাদের বাঁচাতে গ্রামবাসীদের উৎসাহের অভাব হল না। আগের সন্ধ্যায় নেকড়ের আঁচড় কামড়ে ক্ষত বিক্ষত দুলিকে তাদের ঘরের সঙ্গেই পুড়ে যেতে হল। দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারল না দুলির মা।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বাসরাস্তায় এসে একটা চলন্ত বাসও পেয়ে গেল। বেশ খানিক্ষণ পরে যেখানে নামল, সেখানে বাসরাস্তার একদিকে জঙ্গল আরেকদিকে ক্ষেত। এগিয়ে চলল বাসরাস্তার ধারের জঙ্গলের ভেতর। দাঁড়াল, এগোল, বসল, এগোল, হোঁচট খেল, পড়ল, উঠল আবার এগোল। মাটিতে মেশার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার লড়াইতে ব্যস্তকুঁড়ে ঘরটা পেয়ে তার মধ্যেই নিজেকে ঠেলে দিল সে।
কুঁড়ে আর সে টিঁকে গেল। গভীর রাতে দুলিইইইইইই দুলিইইইইইরে বলে মাঝে মাঝে বুকফাটা চিক্কুর ছাড়ে সে। সেই আর্তনাদ দহের ওপারের জঙ্গল পেরিয়ে গ্রামে পৌঁছতে জেগে থাকা বা ঘুম ভাঙ্গা গ্রামবাসী কেঁপে ওঠে।

“তারাশঙ্করের ডাইনি পড়া আছে?”
বাংলার ব্রজেনবাবুর প্রশ্নে অবাক হলেও, দীপক বলল, “নাইনে সিলেবাসে যেটুকু ছিল ওইটুকুই।
“ওতেই হবে ছাতিফাটার মাঠ নামটা পড়েছ তো?”
“তা পড়েছি”।
“এখানেও আছে, তবে নাম ছাতিফাটার মাঠ নয়, আর ডাইনি শুধু ওখানেই থাকে না গোটা অঞ্চলেই আছে। সাবধানে থেক বাপু” শিক্ষকরা কেউ শব্দ করে কেউ মুখ টিপে হাসল।
“এই নব্বুই সালে ডাইনি!” মনে মনে বলল দীপক। মুখে বলল, “আপনারা তো আছেনই।”
“তা আছি তবে সাবধানে থেক” বললেন অঙ্ক স্যর রেবতীবাবু।
মাথা নাড়ে দীপক। এই স্কুলের সব শিক্ষকই তার থেকে বয়সে বড়, কেউ বেশী কেউ কম। হেডমাস্টার মশাইয়ের সামনের বছর রিটায়ারমেন্ট।
বীরভূমের একরকম প্রত্যন্ত গ্রাম পাথরডুবির একমাত্র হাইস্কুলে চাকরিটা পাওয়ার পর একরকম নাচতে নাচতেই চলে এসেছে সে। কাল বিকেলেই এসে পৌঁছেছে, আপাতত হেডমাস্টারমশাইয়ের বাড়িতেই উঠেছে। আজ তার স্কুলে প্রথমদিন।
দিনটা স্কুলে ভালই কাটল দীপকের।
জানলা দিয়ে তাকাতেই চোখ পড়ল দোতলার বারান্দায় এক নারীমূর্তি। একটু অবাকই হল, এত রাতে ঐ বারান্দায় কে দাঁড়াবে! তার আজ বই পড়তে পড়তে কিছুটা দেরীই হয়েছে, তারপর রান্না চাপিয়েছে। দোতলার বারান্দার আলোয় ভাল দেখা যাচ্ছে না। পরনে শাড়ি বোঝা যাচ্ছে, মাথার চুলগুলো খোলা, দোতলায় এর আগে যে মহিলাদের দেখেছে, এ তাদের মধ্যে কেউ নয়। বাড়ির সবাই ভারিক্কী গিন্নীবান্নি মাঝ বয়সী। বয়স বোঝা যাচ্ছে না বটে তবে ছিপছিপে চেহারার এই মহিলা বাড়ির ওই তিন মহিলার কেউ নয় বোঝাই যাচ্ছে।
এই বাড়িতে সে উঠে এসেছে। এই অজ গাঁয়ে বাড়ি ভাড়া পাওয়াও মুস্কিল। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর শেষকালে জায়গা পাওয়া গেছে এই মহেশ রায়ের বাড়িতে। বাড়িটা প্রায় গ্রামের শেষ প্রান্তে, স্কুলটা এখান থেকে কাছে। রায়েরা এককালে বেশ বড়লোক ছিল, স্কুলটাও তার পূর্বপুরুষের তৈরি। গেটের ভেতর দোতলা বাড়িটার সামনেই পাঁচিলের ধার ঘেঁষে দেড়খানা ঘর, হয়ত চাকর বাকরদের জন্যে তৈরি হয়েছিল, এখন কেউ থাকে না। কীর্ণাহারে নিজের বাড়ি করার আগে স্কুলের ইংরাজী স্যর ভোলানাথবাবু এখানেই ভাড়া ছিলেন। প্রেসার কুকারের সিটির আওয়াজ আসতেই জানলা ছেড়ে স্টোভের দিকে এগোল সে। রান্নাঘর বলে আলাদা কিছু নেই ওই ছোট ঘর যেটা সেটাকেই সে রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করে।
স্টোভ নিভিয়ে আবার জানলার সামনে এসে দাঁড়াল। দোতলার বারান্দায় এখন কেউ নেই।
শুয়ে পড়া মাত্রই সে ঘুমিয়ে পড়ে আর এক ঘুমেই রাত কাবার হয়। ভোরে উঠে মর্ণিং ওয়াকে বের হয়। আজ কিন্তু ঘুমটা ভাল হল না। বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল আর যতবার তার ঘুম ভাঙ্গছিল, ততবারই মনে হচ্ছিল ঘরে সে ছাড়াও আরো কেউ আছে। আবছা ঘুমের মধ্যে তার কেবলই মনে হতে থাকল শাড়ি পরা কেউ তার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে কিছু বলতে চাইছে, এরকমটা যখনই মনে হচ্ছে তার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে, যদিও নাইট ল্যাম্পের হালকা আলোয় ঘরে যে সে ছাড়া কেউ নেই সেটাও বুঝতে পারছে।
যথারীতি ভোরের আলো ফোটার আগেই উঠে দাঁত মাজতে মাজতে রাতের ঘটনা নিয়ে ভাবতে গিয়ে একটা সহজ ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলল। কাল বিকেলে গিয়েছিল সেই মাঠটা দেখতে। সে হেডস্যার এবং অন্যদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছিল ওটার আসলে নাম ডুমুরদহের মাঠ। কোন এককালে ওখানে একটা জলা ছিল, তার নাম ছিল ডুমুরদহ। কালে কালে সে দহ বুঁজে গিয়ে মাঠের মত হয়ে যায়। আগে দহের চারদিকে যে জংলা মত ব্যাপারটা ছিল এখন সেই জঙ্গল আরো বেড়েছে। কেউই খোলসা করে বলেনি, তবে সবাই বলেছে জায়গাটা ভাল না। কেউ সেদিকে বড় একটা যায়ও না। সে ভূত প্রেত ডাইনি জ্যোতিষ তন্ত্র মন্ত্র কিছুতেই ভয় বা ভক্তি করেনা এমনকী ভগবানেও না। আসলে বাপ মা মরা ছেলে মামা মামীর সংসারে অনাদরে মানুষ হতে হতে এসবে ভয় বা ভক্তি করার অবকাশ পায় নি।
কাল বিকেলে চলে গিয়েছিল ওখানে, মাঠ বলে প্রায় কিছুই নেই, মাঝখানে কিছুটা বড় বড় ঘাস, উলুখাগড়া ভরা জমি, সেটাই বুঝি এককালে ঐ দহ ছিল আর তাকে ঘিরে পুরোটাই আগাছা, ঝোপঝাড় আর কিছু বড় গাছের জঙ্গল। বড় গাছ বলতেও সবই জংলী গাছ। জায়গাটা বেশ ছায়া ঘেরা ঠান্ডা ঠান্ডা। সত্যি কথা বলতে কী তার বেশ গা ছমছমই করছিল। আসলে সে ঐ জায়গায় গিয়ে পৌঁছতেই আচমকা কেমন একটা হাওয়া দিল। গাছের পাতায় একটা ঝিরিঝিরি শব্দ। কে যেন তার কানের কাছে কিছু ফিসফিসিয়ে বলল। চমকে তাকিয়ে দেখল আশে পাশে কেউ নেই। জায়গাটায় কুকুর গরু ছাগল তো দূর একটা কাক বা পাখীও নেই। হাওয়াটা থেমেও গেল প্রায় সাথে সাথেই। দহের ওপারের জঙ্গলটা আরো ঘন। ওই জঙ্গলের ওপারে বাস রাস্তা। সে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, কেন কে জানে গা ছমছম করলেও তার জায়গাটা খুব ভালোও লাগছিল। আবারো দমকা হাওয়াটা দিতে খুব মৃদু একটা মেয়েলী গলায় কেউ খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসি শুনে তার ভয় করল না, উলটে এতক্ষণের গা ছমছমানি ভাবটাও কেটে গেল। সে আরো ঢুকে এল জঙ্গলের ভেতর, বেশ খানিকটা এগিয়ে এল দহর দিকে, তার কানে নাকি মনের ভেতর কেউ যেন একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিল, “এস এস”। জঙ্গলে সাপ খোপ থাকতে পারে মনে হতেই সে পিছিয়ে এসেছিল। দ্রুত আলো পড়ে আসছে, ঘুরে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি এগোতে গেল, কিন্তু ঘোরার মুহূর্তে তার মনে হল যজ্ঞিডুমুর গাছটার পাশ দিয়ে কেউ দৌড়ে চলে গেল, একটা শাড়ির উড়ন্ত আঁচল যেন দেখতে পেল। সাথে সাথে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ভাল করে দেখল, নাঃ কোথাও কেউ নেই। পা চালিয়ে ঘরের পথ ধরল। সারাক্ষণ একটা অস্বস্তি হলেও সে কিন্তু জানতে পারেনি দহের ওপারে গাছের আড়াল থেকে দুটো তীক্ষ্ণ চোখ তার সাথে মোড়লের ব্যাটার মিল খুঁজে চলেছিল। গ্রামের রাস্তায় যেতে যেতে তার হাসিই পাচ্ছিল, ডাইনি, ‘ছাতিফাটার মাঠ’ কথাগুলো তার মনের ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছে ভেবে।
আজ এখনও হাসি পেল গোটা ঘটনাটা কাল রাতে তার ঘুমের বিঘ্ন ঘটিয়েছে দেখে।

মর্নিং ওয়াকের অভ্যাসটা এখানে এসেও বজায় রেখেছে। সবে আলো ফুটেছে, নরম আলো চরাচরে ছড়িয়ে পড়ছে, পাখপাখালির ডাকে ঝিরঝিরে হাওয়ায় বেশ লাগছিল, রাতে বৃষ্টি হয়েছিল ভালই, চারদিকের গাছগুলো একদম সতেজ, সদ্য স্নান সেরে আসা যুবতীর মাথার চুল বেয়ে গড়িয়ে এসে পড়া জলের ফোঁটার মত গাছগুলোর পাতা থেকেও থেকে টুপটাপ জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছে। শহুরে মানুষ গ্রামের এই পরিবেশে মুগ্ধ। তার থমকে যাওয়ার কারণ সামনের মেয়েটি, পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে গোড়ালি তুলে টগর ফুলের গাছ থেকে ফুল পাড়ছিল মেয়েটি, গাছটা রাস্তার ধারের একটা বাড়ির বেড়ার ওপারে আছে কিন্তু ডালগুলো কাঁচা রাস্তাটার ওপর এসে পড়েছে। একঢাল খোলা চুল কোমর ছাড়িয়ে নেমেছে, ছিপছিপে অথচ ভরাট শরীর, তার নজর গাছের দিকে, সে টেরই পায়নি দীপক দাঁড়িয়ে আছে। বেশীক্ষণ নয়, মেয়েদের একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে যা দিয়ে তারা খুব দ্রুত টের পেয়ে যায় যে কেউ তাদের দেখছে, এই মেয়েটাও পেল আর সরাসরি তাকাল দীপকের দিকে। মেয়েটা গাছের ডাল ছেড়ে দিয়ে খানিকটা সরে আসায় তার মুখটা স্পষ্ট দেখা গেল। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে দীপকের হৃৎস্পন্দন কয়েকগুণ বেড়ে গেল, তার মনে হল সমস্ত বিশ্ব চরাচর, সময়, সব থমকে দাঁড়িয়েছে, ওই দুটো চোখ থেকে তার চোখ সরাতেই পারছিল না। তার অবস্থা দেখে মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠতেই, লজ্জা পেয়ে দ্রুত চলতে শুরু করে দিল সে। প্রায় একমাস হতে চলল এ গাঁয়ে এসেছে, রোজই মর্নিং ওয়াকে যায়, সকালে স্কুলে যাওয়া বিকেলে ফেরা এছাড়া বিনা কারনেই গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়ান তার রোজকার রুটিন, কোনদিন মেয়েটাকে তো দেখেনি আগে! এমন সুন্দর দেখতে মেয়ে এ গ্রামে আছে সে আজই জানতে পারল, রঙটা একটু চাপা এই যা।
ঘরে ফিরে রান্না চাপিয়ে দিল। রান্না সে দুটোই জানে, হয় সব সেদ্ধ নয় খিচুড়ি আর ডিমভাজা। আজ খিচুড়ি আর ডিমভাজাই করল। স্কুলে যাবে বলে ঘর থেকে বেরিয়েই দেখল একটা যুবতী মেয়ে রায়বাড়ির দরজার সামনে তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে কিছু করছে। একেই তাহলে কাল রাতে দোতলার বারান্দায় দেখেছে। রায়েদের কোন আত্মীয় হবে, এসেছে গতকাল। শনিবার তাড়াতাড়ি ছুটি, বাড়ি ঢুকতেই যার সাথে ধাক্কা লাগছিল প্রায় তাকে দেখে বেশ অবাক হল। সকালের সেই ফুলচোর মেয়ে! তার দিকে কৌতুকের ঝিলিকভরা চাউনি দিয়ে মুচকি হেসে গেট খুলে বেরিয়ে গেল। ঐ চাউনি, ঐ হাসি দীপককে পাগল করে দিল। এই তবে রায়েদের আত্মীয়, কাল রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। বিকেল হতে না হতেই ডুমুরদহের মাঠ তাকে টানতে লাগল। আজ সেখানে পৌঁছে সবে একটু এগিয়েছে, তার মনে হল যজ্ঞিডুমুরের গাছটার আড়ালে কিছু একটা নড়ছে, এই সময় সেই দমকা বাতাসটা সেই খিলখিল মেয়েলী হাসিটাকে বয়ে নিয়ে এল আর সে মন্ত্রমুগদ্ধের মত এগিয়ে চলল। যজ্ঞিডুমুরের গাছটার কাছে গিয়ে সে একটা চমক খেল, গাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়েটি। তাকে দেখেই মেয়েটি খিলখিল করে চাপা গলায় হেসে উঠল।
“আপনি মহেশ রায় মহাশয়ের আত্মীয়?” নিজের ভোম্বলভাবটা কাটাতে কথা শুরু করে দীপক।
মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে, “রোজ এখানে আসেন?”
“রোজ নয়, কাল এসেছিলাম আর আজ। আপনার আসতে ভয় করল না?”
“কেন? ভয় করবে কেন?”
“ঐ যে গাঁয়ের লোক কতরকম কথা বলে!”
“ডাইনি?”
“হ্যাঁ, ওই আর কী……”
“আমাকে দেখে কি ডাইনি মনে হয়?”
“ধুর! কী যে বলেন! আমার নাম দীপক, আপনার নাম জানা হল না…”
“মোহিনী। মোহিনী ডাইনি” বলেই হেসে ওঠে মেয়েটা। কথায় কথায় সন্ধ্যে হয়ে আসে। দীপকের খুব ভাল লাগছিল কথা বলতে কিন্তু সন্ধ্যে নেমে আসায় ফিরতি পথ ধরে সঙ্গে মোহিনীও। আগের দিনের মত ফিরতি পথ ধরার সময় আজও একটা দমকা হাওয়া যেন ফিসফিস করে কী যেন বলে গেল।
সে একটু এগিয়ে চলছিল মোহিনী ছিল পেছনে, কিছুদূর এসে কথার উত্তর না পেয়ে পেছন ফিরে দেখল পেছনে কেউ নেই। গ্রামের মধ্যে দিয়ে তার সাথে যাওয়া বোধহয় ভাল দেখায় না, তাই মোহিনী কোনভাবে অন্য রাস্তা ধরেছে। ঘরে ফিরে দেখল তার ভাবনা সঠিক। মোহিনী দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
এরপর প্রতি বিকেলেই ডুমুরদহের মাঠে যাওয়া আর সেখানে মোহিনীর সাথে গল্প করা তার নেশার মত হয়ে উঠল। মাঝে মাঝে সন্ধ্যের পর সে যখন রান্না চাপায় তখনও মোহিনী তার ঘরে চলে আসে গল্প করে। রায়বাড়ির কেউ দেখলে বিপদ হতে পারে, এমন কথাকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেয় মোহিনী, কিন্তু মোহিনীর পরিচয় আজও জানা হল না। অবশ্য জানার জন্যে সে বিশেষ ব্যস্তও হয় না।
আজকাল কোন কাজেই মন বসে না। অষ্টপ্রহর মন জুড়ে থাকে মোহিনী। কখন বিকেল হবে, ডুমুরদহের মাঠে যাবে, মোহিনীর সাথে দেখা হবে, এই চিন্তাতেই বিভোর থাকে। চেহারাতেও পরিবর্তন আসে। উজ্জ্বল চোখ দুটোর কোলে কালি, শরীরটাও অনেক শুকিয়ে গেছে, তার ফর্সা রঙ যেন কেমন ফেকাশে হয়ে গেছে।
তার এই শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন নজর এড়ায় না কারো।
হেডস্যার একদিন বললেন, “খাওয়া দাওয়া মনে হয় ঠিকঠাক হচ্ছে না, আপনার চেহারা বেশ খারাপ হয়ে গেছে”।
ব্রজেনবাবু সরাসরিই বললেন, “কোথায় গ্রামের তাজা বাতাসে শরীর সারবে তা নয় উল্টে রোগা হয়ে যাচ্ছ! ডুমুরদহের মাঠের দিকে যাও না তো!”
মাঝরাতে বৃষ্টির ছাঁট গায়ে লাগতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাইরে প্রবল বৃষ্টি তার সাথে ঝড়, কী করে যেন দরজাটা খুলে গেছে। দরজা বন্ধ করতে উঠতেই ভীষণ চমকে উঠে দেখল তার পায়ের কাছে বিছানার এক ধারে বসে আছে মোহিনী।
“ক্‌ কী ব্যাপার?” তুতলিয়ে বলে দীপক।
হঠাৎই ফুঁপিয়ে ওঠে মোহিনী, “আমাকে কেউ দেখতে পারে না, পছন্দ করে না”।
মোহিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দীপক বলতে থাকে, “আমি আছি তো”।
মোহিনী দীপকের বুকে মাথা রাখতেই দীপক তার ভেতরে জলোচ্ছ্বাস টের পায়। প্রবল ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে মোহিনীকেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে দীপক।
পরদিন মেঘমুক্ত আকাশে ঝকঝকে আলো উঠলে দীপকের বিছানাতেই তার মৃতদেহটা পাওয়া যায়। প্রবল আতঙ্কে তার চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। দেখে মনে হচ্ছিল তার শরীরে যেন একফোঁটাও রক্ত নেই।
গভীর রাতে অনেকেই শুনেছিল ডুমুরদহের মাঠের দিক থেকে ভেসে আসা একটা অট্টহাসি।

সমাপ্তম

Previous articleব্রেন ডেথ
Next articleএখন যখের ধন
Reader of Bengali literature. Try to writing fiction in Bengali.